বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে খেজুরের রস। এ মৌসুমে গ্রামবাংলায় খেজুর রস থেকে তৈরি পিঠা আর নবান্নের উৎসব প্রাচীন ঐতিহ্য। খেজুর রসের পিঠা-পায়েস বাংলার উপাদেয় খাদ্য তালিকায় এখনও জনপ্রিয়। কারণ শীত মৌসুমজুড়ে আহরিত সুমিষ্ট রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও পাটালি। খেজুরের রস থেকে এক সময় বাদামি চিনিও তৈরি করা হতো, যার স্বাদ ও ঘ্রাণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। খেজুর গাছের সুমিষ্টি রসের ম ম ঘ্রাণে ভরে উঠত গ্রামাঞ্চল। পুরো শীত মৌসুম চলত সুস্বাদু পিঠা, পায়েস আর পুলিসহ নানা রকমের পিঠা খাওয়ার আয়োজন। বাড়িতে-বাড়িতে জামাই, মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে চলত শীত উৎসব। তৈরি করা হতো নানা ধরনের পিঠা। খেজুরের রসের গুড় ছাড়া শীত মৌসুমের পিঠা খাওয়া যেন জমেই না। পুরো শীতজুড়ে গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক এ উৎসব চলে আসছে আবহমানকাল ধরে। খেজুর রস গ্রামবাংলার শীতের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। এ যেন সৃষ্টি করে প্রকৃতি ও জীবনের শরীরে শীতের অন্যরকম এক মোহনীয় সৌন্দর্য। সেসব এখন অনেকটাই স্মৃতি।
একসময়ে মানিকগঞ্জের খেজুর রসের তৈরি হাজারি গুড় বলে লোভনীয় স্বাদ আর মনমাতানো সুগন্ধে অতুলনীয় গুড় এই বাংলায় ছিল। তৎকালীন সময়ে নাকি এই হাজারি গুড় দিল্লির বাদশাহ এবং যুগপৎ ইংল্যান্ডের মহারানিকে উপহার হিসেবে পাঠানো হতো। এদিকে লোকমুখে জানা যায়, ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যরা হাজারি গুড় ছাড়া অন্য গুড় দিয়ে ফিরনি, পায়েস বা ক্ষির পাক করলে সেটি মুখেই দিতেন না। কেননা, নবাবদের খাদ্য তালিকায় হাজারি গুড় খুব পছন্দের একটি উপাদান ছিল। এমনও দেখা গেছে যে, শীতকালে নবাব পরিবারের গৃহিণীরা এ মৌসুমি হাজারি গুড়ের জন্য অপেক্ষা করতেন। কিন্তু হাজারি গুড়ের সেই ঐহিত্য আর নেই। এদিকে মাদারীপুরের কাচফোটের পাটালি গুড় একই ধারায় প্রসিদ্ধ। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতেও যশোরের খেজুরের গুড় পাটালির জন্য বিখ্যাত ছিল। ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’Ñ এমন প্রবাদই প্রমাণ করে যশোরের খেজুর রসের জনপ্রিয়তা। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘একসময় যশোর অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ পণ্য ছিল খেজুরের গুড়। ১৯০০-২০০১ সালে পুরো বঙ্গে খেজুরের গুড় উৎপাদিত হতো ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে শুধু যশোরেই উৎপাদিত হতো ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ, সেই সময় যার দাম ছিল ১৫ লাখ টাকা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই গুড় আমেরিকা-ইউরোপেও রপ্তানি হতো।
বর্তমানে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয়, এমন একদিন আসবে, তখন শুধু বইয়ের পাতায় কিংবা ফেইসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব স্বনামধন্য গুড়ের নাম জানা যাবে, বাস্তবে এর টিকিটিও দেখা যাবে না। আমাদের আগামী প্রজন্ম কি শুধুই বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শোনবে, আর বইয়ের পৃষ্ঠা পড়ে অতৃপ্তির ঢেঁকুর গিলে যাবে?
বাঙালির ঐতিহ্যের অহংকার মধুবৃক্ষ আজ অসচেতনতা, অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। আশপাশে, রাস্তার দুইধারে, ফসলি জমির আইলে আগের মতো খেজুর গাছ দেখা যায় না। কেউ কেউ শুধু শীত মৌসুমে রস পাওয়ার আশা না করে অধিক লাভবান হওয়ার আশায় খেজুর গাছ বিক্রি করে, সেখানে রোপণ করছে বিদেশি প্রজাতির গাছ, যা আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে খেজুর গাছ দিন দিন হারিয়ে গেলে এক সময় খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। তাহলে কী বাঙালির অহংকার খেজুর রসের পিঠা-পায়েসের উৎসব আমরা ধরে রাখতে পারব না! এজন্য ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুর গাছ রোপণ করা এবং যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি।
শিক্ষার্থী
অর্থনীতি বিভাগ, সরকারি
তিতুমীর কলেজ, ঢাকা