মানব দেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণে ফলের বিকল্প নেই। কোনো অনুষ্ঠান বা অতিথি আপ্যায়নে ফল ছাড়া চলেই না। এছাড়া দেশের মানুষের কাছে বাসাবাড়ি বেড়াতে কিংবা রোগীর সঙ্গে দেখা করতে ফলের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দেশে যেমন ফলের চাহিদা রয়েছে, প্রচুর উৎপাদনও হচ্ছে। তারপরও ফল আমদানি করতে হচ্ছে। খুচরা মূল্যে প্রতিদিন ফল বেচাকেনা হচ্ছে কমবেশি ২৭ কোটি টাকার। ধারণা করা হচ্ছে, দেশে খুচরা পর্যায়ে বছরে ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। এ আমদানির হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, দেশীয় ফলের বাজারে বছরের পাঁচ মাসের রাজত্ব বিদেশি ফলের। বছরের পাঁচ মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চলে বিদেশি ফল। আমদানির হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১৬ লাখ ৮৮ হাজার কেজি বিদেশি ফল খাচ্ছে দেশের মানুষ। বছরের পাঁচ মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চলে বিদেশি ফল। কারণ, এ সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ কম থাকে।
এদিকে বিদেশি ফলের দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রাজধানীর বাদামতলী। জাহাজে করে আর বিভিন্ন পরিবহনে প্রতিদিনই ফল আসছে এ বাজারে। পাইকারি ফল ব্যবসায়ীরা বলেন, সকালে ফলের বাজার সরগরম থাকে। যদিও রাত ৯টা পর্যন্তই ফলের বাজার খোলা। তবে সকালেই বেশি জমজমাট থাকে এ বাজার। এখানে পাইকারি বাজারের মতো চাঙ্গা এখন খুচরা বাজারাও।
বর্তমানে ঢাকা শহরের খুচরা ফলের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, আপেল ১৩০ থেকে ১৫৭ টাকা, নাশপাতি ১৭০ টাকা কেজি, কমলা প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা, মাল্টা মানভেদে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি, আঙুর প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ২৮০ দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, দেশে ২৫ থেকে ৩০ জাতের বিদেশি ফল আমদানি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় খেজুর, আপেল, মাল্টা, আঙুর, কমলা, আনার, নাশপাতি, ড্রাগন, কেনু, থাই পেয়ারা, থাই পেঁপে ইত্যাদি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৪৬টি দেশ থেকে আপেল, কমলা, মালটা, আঙুর, নাশপাতি, ডালিমÑ এই ছয়টি ফল আমদানি হয়। এর মধ্যে ভারত, চীন, ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভুটান, মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম। এছাড়া আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি, মাল্টা, চেরি, আনার, বরই, আম ছাড়াও বেবি ম্যান্ডারিন, পাম, নেকটারিন, কিউইর, সুইট মিলান, এবাকাডোর মতো কিছু অপরিচিত ফল আমদানি করা হয়।
অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, ভুটান ও ব্রাজিল থেকেই এসেছে মোট আমদানির ৯৪ শতাংশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে সীমিত পরিমাণে ফল আসছে। ফল ব্যবসায়ীরা বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কমলা আমদানি হয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে। এর বাইরে অবশ্য স্থলপথ দিয়ে ভারত থেকেও আমদানি হয়, কিন্তু সেটি নির্দিষ্ট কয়েক মাসে। আর সমুদ্রবন্দর দিয়ে বছরজুড়েই আমদানি হয় মাল্টা; মিশর থেকে আসে নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত। আর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসে বাকি সময়ে। কমলা আসে প্রধান চীন থেকে, কিছু সময় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও আসে। সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ১৫ লাখ ৭৭ হাজার কেজি বিদেশি ফল দেশে ঢুকছে। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশি ফল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি হয় ভারত থেকে স্থলপথে; যা সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বুড়িমারী ও হিলির স্থলবন্দর দিয়ে আসে।
বিদেশি ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় আপেল, আঙুর, কমলা, মাল্টা, ডালিম ও নাশপাতি। চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা বিমানবন্দর, ভোমরা, সোনামসজিদ, হিলি স্থলবন্দর ছাড়াও বেশ কয়েকটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে ফল আসে। ফল আমদানিকারকরা বলেন, শীতের মৌসুমে দেশি ফল উৎপাদন কম হওয়ায় বিদেশি ফলই একমাত্র ভরসা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফল আমদানির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫১ হাজার ২৫৫ টন। এ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭ কোটি টাকার আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুর আমদানি হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রতিদিন দেশে ১০ লাখ কেজি বিদেশি ফল আমদানি হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকার ফল আমদানি হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রতিদিন বিদেশি ফল আমদানি হয় ১৫ লাখ ৭৭ হাজার কেজি, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। ৫ বছরের ব্যবধানে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯ আমদানির হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৩০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)।
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে মোট ৪ দশমিক ৫৮ লাখ টন বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ৬১ লাখ টন। ৫ বছরে আমদানি বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১৬ হাজার টন এবং মোট আমদানির প্রায় ৭৭ শতাংশই হচ্ছে আপেল ও মাল্টা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ১৬ হাজার টন। মোট আমদানির ৭৭ শতাংশই হচ্ছে আপেল ও মাল্টা।
ফল আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিমুল হক এশা বলেন, দেশে যেসব ফল উৎপাদিত হয় না, সেগুলোই আমদানি হচ্ছে। আমদানিকারকরা এ দেশে ফলের বাজার তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন বলেন তিনি।
ফল আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সমিতি বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, যেসব বিদেশি ফল আমদানি হচ্ছে, সেগুলো দেশে কার্যত উৎপাদন হয় না। তাই আমদানির বিকল্প নেই। সারা বছর বিদেশি ফলের চাহিদা রয়েছে। তবে পাঁচ মাস বিদেশি ফল বেশি বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য এমএ সাত্তার ম-ল বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ায় ফলের চাহিদা বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা ফল আমদানি করে পুষ্টি চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছেন। এদিকে গবেষকরাও নজর দিয়েছেন। আবার দেশীয় উদ্যোক্তারাও বিদেশি ফলের চাষ করছেন। এর ফলে বাজারই বলে দেবে কোনো ফল আমদানি হবে, কোনোটি হবে না।
কৃষিবিদরা বলেন, পেঁপে ও কলা সারা বছরই ফলে। এই দুটি ফল সব সময় পাওয়া গেলেও সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বাজারে দেশি ফলের সরবরাহ সবচেয়ে কম থাকে। এর কারণ, ওই পাঁচ মাস সাধারণত কুল, পেয়ারা (থাই) ছাড়া অন্য কোনো দেশি ফলের মৌসুম নয়। তাই এই পাঁচ মাস বাজার একচেটিয়া বিদেশি ফলের দখলে চলে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ বলেন, আগের চেয়ে ফল আমদানি অর্ধেকে নেমে গেছে। দেশে বর্তমানে ১০ থেকে ১২টি বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ও ডালিম। যেভাবে এ চার ফলের উৎপাদন বাড়ছে, তাতে এগুলো একসময় আমদানি করতে হবে না। তিনি বলেন, দেশে বছরে সোয়া ১ কোটি টন ফল উৎপাদন হয়। দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফলের সন্ধান রয়েছে, তার মধ্যে প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রায় ৭২টি ফলের চাষাবাদ হয়। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশের। এখন সারা বছর ২২ জাতের ফল নিয়মিত খেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, সুস্বাস্থ্যের জন্য এক জন মানুষের প্রতিদিন গড়ে ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। দেশের মানুষ দৈনিক ৭৬ গ্রাম ফল খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আগে এর পরিমাণ ছিল ৫৫ গ্রাম। মানুষের চাহিদার কারণে একদিকে দেশে ফল উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ফল আমদানি।
কমলা-মাল্টা : কাস্টমসের তথ্য বলেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ টন কমলা-মাল্টা আমদানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমলা-মাল্টা আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমলা-মাল্টা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৭০ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কমলা-মাল্টা এসেছিল মাত্র ৫৬ হাজার টন।
আপেল : চট্টগ্রাম কাস্টমস জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আপেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪০৩ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আপেল আমদানি হয়েছিল ২ লাখ ১৮ হাজার ১৬৩ টন। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আঙুর আমদানি হয়েছে ১৫ হাজার ৫২৯ টন।