অফুরন্ত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে আমাদের ওপর ছায়াপাথ করেছে পবিত্র মাহে রমজান। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর যখন বর্ষাকালে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, তখন আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। খাল, বিল, পুকুর, নদীনালা চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। কৃষক বিলে-মাঠে ধান বোনার উৎসবে মেতে উঠেন। কারণ, বর্ষাকাল ছাড়া মাছের প্রজনন বপা ধান বোনার ও ভালো ফলনের আশা করা যায় না আমাদের ছয় ঋতুর দেশে। এই হিসাবে বর্ষাকাল আমাদের জীবন ও প্রকৃতির জন্য আল্লাহর অফুরান দান। শীতপ্রধান দেশগুলোয় ঋতু চারটি। সেখানে শীতকালে বরফের চাদরে চারদিক ছেয়ে যায়। জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। যখন বষন্তকাল আসে, গোটা প্রকৃতি নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠে। গাছপালা সজ্জিত হয় নবীনবরণে নতুন পত্রপল্লবের সাজে। পাখিরা কুজন করে, মনের আনন্দে ফুলের শাখায়, লতায়-পাতায় দোল খায়। বিশ্ব প্রকৃতি সজ্জিত হয় অপূর্ব সাজে, বসন্তের বর্ণাঢ্য সৌরভে। বসন্তকাল ছাড়া অন্য সময়ে প্রকৃতির এমন নান্দনিক ঐশ্বর্য অকল্পনীয়। আমাদের দেশে শীতের ভিন্ন আমেজ আমরা পুলুকিত হই। রবি শষ্য আর ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় নয়ন জুড়ানো সবুজের ফরাশ বিছানো ক্ষেতের মাঠ। তার মানে, বিশ্ব প্রকৃতিতে প্রতিটি মৌসুম নিয়ে আসে মানব জাতির জন্য আলাদা সওগাত, স্বতন্ত্র উপহার।
বিশ্ব প্রকৃতিতে দৃশ্যমান এসব প্রপঞ্চের মতো প্রত্যেক মাসে ও মৌসুমে আত্মিক জগতেও আছে নানা আয়োজন, নানা সওগাত ও রহমতের ফল্গুধারা। প্রাকৃতিক জগত নিয়ন্ত্রিত হয় প্রধানত সূর্যের প্রভাবে। আর আত্মিক জগত নিয়ন্ত্রিত হয় চাঁদের প্রভাবে ও আকর্ষণে। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা, মাতৃগর্ভে শিশুর বেড়ে উঠার দিনক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে চাঁদের পরিক্রমা। সেই পরিক্রমায় প্রতি বছর দুনিয়ার বুকে আল্লাহর অফুরান রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে আসে মাহে রমজান। তাই মাহে রমজানকে আমরা আত্মিক জগতের বসন্ত বা বর্ষাকালের সাথে তুলনা করতে পারি। রমজান মাসের এই আত্মিক মহিমার কথা নবীজি বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন উপমায়, সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায়।
এক হাদিসে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন রমজান মাসের প্রথম রাত এসে পড়ে তখন শয়তান ও অবাধ্য জীনদের বন্দি করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়; এর একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়; এর একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। আল্লাহর পক্ষ হতে এক আহ্বানকারী ফেরেশতা ডাক দিয়ে বলতে থাকে- হে কল্যাণ অনুসন্ধানকারী কল্যাণকর কাজে এগিয়ে এসো। হে মন্দ অনুসন্ধানকারী! মন্দ কাজ হতে থেমে যাও। এ মাসে মহান আল্লাহর অনুগ্রহে অনেক মানুষ জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে। আর রমজান উপলক্ষ্যে এই প্রক্রিয়াটি প্রত্যেক রাতেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।’ (তিরমিযি ও ইবনে মাজা)
হাদিসের ভাষ্য থেকে আমরা মাহে রমজানের অতুলনীয় অবর্ণনীয় মহিমার কিছু পরিচয় পেয়েছি। কোরআন মজিদে এদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। রমজান এমন মহিমান্বিত মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে পবিত্র কোরআন। (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৫) আমরা সাধারণত বলে থাকি, রমজান মাসে কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে এই মাসের এত ফজিলত। জীবনের শুরু থেকে বহু লেখায় ও বক্তৃতায় এ কথা আমিও বলেছি। কিন্তু তাফসিরে মাইবেদির একটি অংশ তরজমা করতে গিয়ে, যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত হয়েছে, আমার জ্ঞানের চক্ষু খুলে গেছে। মুফাসসির অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলেছেন, রমজান মাস এতই বরকতময় ও ফজিলতের মাসব যে, রমজানের নিজস্ব ফজিলতের কারণে এই মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। এমনকি অপর তিনটি প্রধান কিতাবও নাজিল হয়েছে এই মাসে।
হজরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণিত হাদিসে হজরত নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের ওপর ছায়াপাথ করেছে এক মহান মাস। এক বরকতময় মাস। এই মাসে আছে এমন একটি রাত, যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই মাসের বরকতের বর্ণনা দিয়ে তিনি ইরশাদ করেন, এই মাসে যদি কেউ একটি সৎকর্ম সম্পাদন করে, তার সওয়াব রমজান ছাড়া অন্য মাসে কোনো ফরজ ইবাদত করার সওয়াবের সমান হবে। আর যদি রমজানে কোনো একটি ফরজ ইবাদত বা সৎকর্ম সম্পাদন করে, তার সওয়াব হবে অন্য সময়ে ৭০টি ফরজ ইবাদত আদায় করার সমতুল্য।
অনুধাবনের বিষয় হলো, পবিত্র মাহে রমজানের প্রতি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত অতিশয় মূল্যবান। চাষিরা বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে চাষাবাদ করতে গেলে হাজারও ভোগান্তি পোহাতে হয়। এরপরও কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায় না। মাহে রমজান নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর পক্ষ হতে মুমিন বান্দার জন্য সুবর্ণ সুযোগ, ইবাদতের মৌসুম। নিজের প্রতিটি কাজ, চিন্তা ও বিশ্বাস, ধ্যানজ্ঞান একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত রাখার এই সুযোগ যেন আমরা হাতছাড়া না করি। যে কোনো অবসরে বা কাজের ফাঁকে কোনো না কোনো তাসবিহ মুখে জারি রাখি। জামাতে নামাজ,কোরআন তেলাওয়াত, সময় মতো ইফতার, তারাবিহ, শেষরাতে তাহাজ্জুদের পরম সৌভাগ্য হতে যেন অবহেলায় বঞ্চিত না হই। আল্লাহ পাক রমজান মাসকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করার তওফিক দান করুন। আমিন।