ঢাকা রোববার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগমাধ্যম দোয়া

আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগমাধ্যম দোয়া

সুরা বাকারার ১৮৫ ও ১৮৭ নং আয়াত দুটি রমজান মাসে কোরআন নাজিল হওয়া এবং রোজা পালনের বিধিবিধান সম্পর্কিত। মাঝখানের ১৮৬ নং আয়াত আল্লাহর দরবারে দোয়া ও মোনাজাত প্রসঙ্গে। গবেষকরা বলেছেন, এতে প্রমাণ হয় পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা ও কবুল হওয়ার অপার সুযোগ নিহিত আছে।

সুরা মুমিনের এ আয়াতটি যখন নাজিল হলো, ‘তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। যারা অহংকার বশে আমার ইবাদত হতে বিমুখ, তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’ (সুরা মু‘মিন, আয়াত-৬০)।

এ আয়াতে আল্লাহ পাক দোয়া করার হুকুম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলছেন, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। লক্ষ্যণীয় হলো, এই দোয়ার জন্য কোনো শর্তজুড়ে দেওয়া হয়নি। এমনকি যারা আল্লাহর ইবাদত করে না, তথা দোয়া করে না তাদের জাহান্নামে দাখিল করার ভয়াবহ সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে।

এ আয়াত নাজিল হওয়াতে সাহাবায়ে কেরাম ঘাবড়ে যান। নবী করিম (সা.) এর খেদমতে কেউ কেউ আরজ করেন, আল্লাহকে আমরা কীভাবে ডাকব? উচ্চস্বরে না নিম্নস্বরে। রাতে না দিনের বেলা। তিনি কী আমাদের কাছে, নাকি অনেক দূরে। এসব প্রশ্ন ও কৌতূহলের জবাবে সুরা বাকারার নিম্নোক্ত আয়াতখানি নাজিল হয়Ñ

‘আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার সম্বন্ধে জানতে চায় (বলুন যে) আমি তো কাছেই। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা ঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৬)।

অভাবী অসহায় মানুষ কোনো বড় লোককে ডাকলে, সাহায্য চাইলে সাড়া দেয় কি-না সন্দেহ থাকে; কিন্তু আল্লাহ পাক অসহায় বান্দার ডাকে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেন। যত বড় ধনী হোক বারবার সাহায্য চাইতে গেলে ফিরিয়ে দেয় কিংবা বিরক্ত হয়। কিন্তু মহান আল্লাহ বান্দা যত চায় তত দেন, চাইলে খুশি হন, কখনও বিরক্ত হন না। বরং না চাইলে রাগ করেন। হাদিসের ভাষ্য ‘যে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন। (তিরমিজির বরাতে মিশকাত-২১৩৩)।

তবে দোয়া হতে হবে কায়মনোবাক্যে, একীন নিয়ে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছেন। মোনাজাত ধরলাম, অথচ মন অন্যদিকে কিংবা দোয়া কবুলের ব্যাপারে সন্দেহ আছেÑ এমন দোয়া কবুল হবে না। ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন। দোয়া কবুল হবে এ বিশ্বাস নিয়ে দোয়া কর। জেনে রেখ যে, আল্লাহ অমনোযোগী অবহেলাকারী অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।’ (তিরমিজির বরাতে মিশকাত-২১৩৬)।

দোয়া কবুল হওয়ার পেছনে যুক্তি আছে, দর্শন আছে। নবীজি বলেন, তোমাদের প্রতিপালক লজ্জাশীল ও দাতা। কোনো বান্দা তার দিকে দুই হাত উঠালে তা খালি ফেরত দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন। (তিরমিজি, আবু দাউদ, বয়হাকি, মিশকাতÑ২১৩৮)।

জানা গেল, দোয়ার সময় হাত তোলা আদব। ভিখারি কারও কাছে সাহায্য চাইতে হাত পাতে। ভিখারি বান্দাও মহামহিমের কাছে চাইতে দু’হাত তুলে দোয়া করে। মনে তার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার দোয়া কবুল হচ্ছে। আমার দুহাত খালি ফেরত দেবেন না। রহমত ও দয়া দিয়ে ভরে দেবেন, দিয়েছেন। মোনাজাত শেষে সেই দয়া-দান কোথায় রাখবেন। সবচে উত্তম প্রিয় জায়গা মানুষের মুখমণ্ডল। বান্দা দু’হাত ভরে পাওয়া রহমত তাই মেখে নেয়, চোখে মুখে বুকে পুরো মুখমণ্ডলে। আল্লাহর দেওয়া রহমত ও দয়া-দানকে এভাবে সম্মান করা ও বরণ করাই হাদিসের শিক্ষা। ওমর (রা) বর্ণিত হাদিসে এরশাদ হয়েছে, রাসুল (সা.) যখন দোয়ায় হাত উঠাতেন হাত দ্বারা আপন মুখমণ্ডল মাসেহ করা ছাড়া নিচে নামাতেন না।’ (তিরমিজি, মিশকাত-২১৩৯)।

প্রশ্ন জাগতে পারে আল্লাহর কাছে কোন ধরনের জিনিস চাইব। ছোটখাটো বিষয় চাইলে. দোয়া করলে তিনি নাখোশ হবেন না তো। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকেই যেন আপন প্রতিপালকের কাছে আপন যাবতীয় আবশ্যক ভিক্ষা করে; এমনকি যখন তার জুতার দোয়ালি ছিঁড়ে যায় তাও ভিক্ষা করে। বর্ণনান্তরে তার কাছে সামান্য লবণও ভিক্ষা করে, নিজের জুতার ফিতাও ভিক্ষা করে, যখন তা ছিঁড়ে যায়। (তিরমিজি, মিশকাত-২১৪৫)।

তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের সব দোয়া কবুল হয়। কিন্তু সেই কবুলিয়াত বা দোয়ার সুফল আমরা পাই না কেন। একটি উদাহরণ সামনে রাখলে এ ব্যাপারে সংশয় থাকবে না। ধনীর দুলাল স্কুলে পড়ালেখা করছে। ছেলের আবদার লেটেস্ট মডেলের গাড়ি দিতে হবে। বিলাসবহুল হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। খরচপাতির জন্য অবাধ টাকা চাই। বাবারা সহায় সম্পদ ছেলের জন্য জোগাড় করলেও আদরের সন্তানের এমন আবদার পূরণ করবে না কোনো দুরদর্শী বাবা। কারণ ছাত্রাবস্থায় এতকিছু পেলে লেখাপড়া গোল্লায় যাবে। বিলাসিতায় পথ হারাবে। তাই ছেলের আবদার পূরণ করবে, এমনকি সব সম্পদ তাকে বুঝিয়ে দেবে, যখন ছেলে জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে পোক্ত হয়ে লেখাপড়া করবে ও সম্পদের কদর বুঝবে।

বান্দা আল্লাহর কাছে দোয়া করে অনেক কিছু। তিনি আলিমুল গাইব। তিনি যদি জানেন, প্রার্থিত জিনিসটি দিলে বান্দার ক্ষতি হবে তার বদলায় এমন কিছু দেন যা তার জীবনের জন্য উপকারী হবে। অথবা বিলম্বে দিবেন, যখন তা ধারণ করার যোগ্যতা হবে। কিংবা দোয়ার বদলায় কোনো অমঙ্গল দূর করেন। অন্তত দোয়াটি সওয়াব হিসেবে রাখেন, যা বান্দা আখেরাতে প্রাপ্ত হবে। (দ্র. মিশকাত-২১৫১)।

দোয়ার মধ্যে আছে মানসিক প্রশান্তি। মনের যত দুঃখ-যাতনা প্রাণ উজাড় করে মহান আল্লাহর কাছে বলতে পারার যে শান্তিÑ ব্যাখ্যা করে বুঝানো যাবে না। টেলিফোন, টিভি বা মোবাইল যোগাযোগে বর্তমানে ‘তার’ লাগে না। সবকিছুতে এখন রিমোট সিস্টেম। দোয়াও অনেকটা রিমোটের মতো। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার যোগাযোগমাধ্যম দোয়া। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদের স্মরণ করব।’ তখন আত্মিক শক্তি সঞ্চারিত হয় বান্দার অন্তরে, গোটা অস্তিত্বে। দোয়ার অপর নাম ইবাদত। হাদিসে দোয়াকে ইবাদতের মগজ বলার দর্শনও এখানেই নিহিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত