বান্দার জন্য আল্লাহর ভালোবাসা
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমরা এক যুদ্ধে নবী করিম (সা.) এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি একদল লোকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানতে চাইলেন, এরা কোন দলের লোক। তারা বলে উঠল, আমরা মুসলমান। এ সময় এক মহিলা ডেকচির নিচে লাকড়ি দিয়ে আগুন জ¦ালাচ্ছিল। তার সঙ্গে ছিল তার একটি শিশু সন্তান। তখন দপ করে আগুনের একটি ফুলকি ওপরে উঠল। অমনি সে ছেলেটিকে টেনে আগুন থেকে দূরে সরিয়ে নিল। এরপর মহিলা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আপনিই কি রাসুলুল্লাহ? হজরত বললেন, হ্যাঁ। মহিলা বলল, আপনার জন্য আমার পিতাণ্ডমাতা কোরবান হোক। আমাকে বলুন, আল্লাহ কি সবার চেয়ে অধিক দয়ালু নন? হুজুর বললেন, নিশ্চয়ই। মহিলা বলল, মা তার সন্তানের প্রতি যতখানি দয়ালু আল্লাহ কি বান্দার প্রতি তার চেয়ে বেশি দয়ালু নন? হুজুর বললেন, নিশ্চয়ই। মহিলা প্রশ্ন করল, মা তো আপন সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করে না। এ কথা শুনে নবী করিম (সা.) নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললেন এবং কাঁদতে লাগলেন। এরপর মাথা তুলে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে চরম অবাধ্য ছাড়া কাউকে শস্তি দেন না-এমন অবাধ্য যে, আল্লাহর সঙ্গে নাফরমানি করে এবং আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই-এ কথা বলতেও অস্বীকার করে। (ইবনু মাজাহ, মিশকাত-২২৬৮)।
বান্দার জন্য আল্লাহর ভালোবাসা কতখানি তার একটি খ-চিত্র এই হাদিস। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার সম্পর্ক বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি মনিব ও গোলামের সম্পর্ক। তার পক্ষে দলিল কোরআনের আয়াত, ‘আমি জিন ও মানব জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত : ৫৬)। ইবাদতের অর্থ অনেক ব্যাপক হলেও আমরা বুঝি দাসত্ব। তার মানে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হবে মনিব ও দাসের সম্পর্কের মতো। সুফি তাত্ত্বিকরা এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তারা বলতে চান, বান্দা ও আল্লাহর মাঝে সম্পর্ক হবে ভালোবাসার।
ভালোবাসার পরিধি অনেক ব্যাপক এবং প্রয়োগ ভেদে তার অর্থ হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছোটদের প্রতি বড়দের ভালোবাসাকে আমরা বলি স্নেহ-মমতা। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার নাম প্রেম। পিতাণ্ডমাতা, গুরুজনের প্রতি ভালোবাসা বলতে ভক্তি ও শ্রদ্ধা বোঝায়। আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে ভালোবাসায় থাকতে হবে ভয় ও আশার মিশ্রণে আনুগত্য ও দাসত্ব। কোরআনের ভাষায় এর নাম ‘হুব’। আরবি ‘হুব’কে ইংরেজিতে বলা হয় ‘লাভ’। বাংলায় প্রেম ভালোবাসা। সুফিরা বলেন, বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক হতে হবে হুব-এর নিরিখে। আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগিতে ভালোবাসার মিশেল থাকতে হবে, তাহলেই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)। তার মানে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ভালোবাসার সম্পর্কের তত্ত্ব শরিয়ত অনুমোদিত।
‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহকে ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালোবাসার মতো তাদেরকে ভালোবাসে। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা সবচেয়ে সুদৃঢ়।’ (সুরা বাকারা : ১৬৫)।
‘হে মোমিনরা! তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন থেকে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদের তিনি ভালোবাসবেন এবং যারা তাকে ভালোবাসবে। তারা মোমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তার রাসুল ও মোমিনরা-যারা বিনত হয়ে নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয়।’ (সুরা মায়েদা : ৫৪, ৫৫)।
ভালোবাসা একপক্ষীয় না, হতে হয় দ্বিপক্ষীয়। আল্লাহ ও বান্দার ভালোবাসার বেলায়ও তা সত্য। উপরোল্লিখিত আয়াতের বাচনভঙ্গি লক্ষ্য করুন। প্রথমে আছে ‘যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন।’ তারপরে বলা হয়েছে ‘এবং যারা তাকে ভালোবাসবে।’ এর একটি অর্থ প্রথমে বান্দার জন্য আল্লাহর ভালোবাসা আগে, তারপর আল্লাহর জন্য বান্দার ভালোবাসা জাগে। মানে কী? তার মানে কেউ যদি মনে আল্লাহর প্রতি, দ্বীনের জন্য ভালোবাসা অনুভব করে, তাহলে বুঝতে হবে ওপর থেকে আল্লাহর তরফে ভালোবাসার হাতছানি এসেছে, যারা বিপথগামী গোনাহখাতায় কলুষিত তাদের প্রতি এই ভালোবাসার হাতছানি আরও তীব্র। নবী করিম (সা.) একটি অভিনব উপমা দিয়েছেন, যা হজরত আব্দুুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন।
‘এক লোক মরুভূমিতে দূরের সফরে রওনা হয়েছে। দুর্গম বিপদ সংকুল মরুবিয়াবানে তার একমাত্র সম্বল উটের বাহন। বাহনের ওপর আছে রসদপত্র, খাদ্য ও পানীয়। ক্লান্ত পথিক এক জায়গায় বিশ্রাম নিতে বসে পড়ে। এক সময় তার চোখে নিদ্রা নেমে আসে। ঘুম ভাঙলে দেখে তার বাহনটি নেই। বাহনের সন্ধানে ছুটাছুটি করে। কিন্তু না, নেই, বাহন নেই। পিপাসায় তার বুক ফেটে যায়। জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে বলে, আগে যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে যাই। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ব। মরণ ছাড়া তো উপায় নেই। আপন বাহুটি বালিশ বানিয়ে সে শুয়ে পড়ে, আর জাগব না। এক পর্যায়ে আবার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে তার বাহন মালপত্র খাদ্য ও পানীয়সহ তার কাছে উপস্থিত। আনন্দের আতিশয্যে সে বলে ওঠে, আল্লাহ তুমি আমার বান্দা আমি তোমার রব। এই মুসাফির তার বাহন রসদপত্র ফিরে পেয়ে যতখানি আনন্দিত কোনো মোমিন তওবা করলে আল্লাহ তার চেয়েও বেশি আনন্দিত হন। Ñ(মুসলিম)।
আসুন গোনাহগাররা আল্লাহর ভালোবাসার হাতছানি পেয়ে ধন্য হওয়ার জন্য ধরনা দিই, তওবা করি। আল্লাহ তুমি কবুল কর।