ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উত্তাল শ্রীলঙ্কা

রাজাপাকসে রাজত্বের পতন

* দেশ ছেড়ে মালদ্বীপ পাড়ি জমালেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া * বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট * শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি * সেনাবাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ
রাজাপাকসে রাজত্বের পতন

শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক টালমাতাল পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে মালদ্বীপে আশ্রয় নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। সেখান থেকে তিনি সিঙ্গাপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর পর শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। আর দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে জারি করা হয়েছে কারফিউ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একজন মুখপাত্র এসব কথা বলেছেন। গোটাবায়া দেশ ত্যাগ করার পর উল্লাসে ফেটে পড়ে শ্রীলঙ্কার হাজার হাজার সরকারবিরোধী। বের করে আনন্দ মিছিল। অল্প সময়ের মধ্যে রাজপাকসের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তারা প্রধনমন্ত্রীর অফিস ও বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। দেশটির তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের শক্ত হাতে দমন করার নায়ক গোটাবায়া সাধারণ জনগণের কাছে কুপোকাত হয়ে এভাবে দেশ ত্যাগ করে প্রাণ রক্ষা করবেন তা তিনি কখনও ভাবেননি। তবে ক্ষমতাসীন একজন প্রেসিডেন্টের দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনা শ্রীঙ্কাকার জন্য একটি বিরল দৃষ্টান্ত।

গোটাবায়াকে মালদ্বীপ পালিয়ে যেতে ভারত সহায়তা করেছে বলে খবর প্রকাশিত হলে তা অস্বীকার করেছে নয়াদিল্লি। মালদ্বীপ থেকে তার পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে সিঙ্গাপুর। গতকাল যে কোনো সময় তার সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা জানিয়েছে গণমাধ্যম। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশটির রাজনৈতিক সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা হবে তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা। খবর বিবিসি এএফপি ও স্থানীয় গণমাধ্যম

গত মার্চ মাস থেকে দেশজুড়ে তার পদত্যাগের দাবিতে অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে অবশেষে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পাড়ি জমালেন তিনি। একটি সামরিক বিমানে করে গোটাবায়া গত মঙ্গলবার রাতে মালদ্বীপের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন বলে জানিয়েছেন অভিবাসন কর্মকর্তারা। তবে সেখানে অবস্থানরত শ্রীলঙ্কানরা তাকে স্থান না দেয়ার জন্য মালদ্বীপের প্রতি দাবি জানিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার ৭৩ বছর বয়সি নেতা গোটাবায়া, তার স্ত্রী ও একজন দেহরক্ষীসহ চার যাত্রী নিয়ে একটি সামরিক বিমানে করে বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালদ্বীপের উদ্দেশে রওনা হন। তবে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেন এবং পার্লামেন্টের স্পিকারও ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে গতকাল রনিল বিক্রমাসিংহের নাম ঘোষণা করেন। দায়িত্ব নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশে তিনি বলে, সংবিধান সমুন্নত রাখতে আমরা ফ্যাসিস্টদের হাতে ক্ষমতা দিতে পারি না। কেননা তারা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। রনিল বিক্রমাসিংহ পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশৃঙ্খলকারীদের গ্রেপ্তার করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা দেশটির জাতীয় টেলিভিশন ভবনে ঢুকে পড়ার পর সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে।

গোটাবায়া আশঙ্কা করছিলেন, প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এজন্য তিনি গত সোমবার রাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের উদ্দেশে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। তবে অভিবাসন কর্মকর্তারা তাকে আটকে দেয়ার পর বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পাশের একটি সামরিক ঘাঁটিতে ফিরে যান তিনি। গোটাবায়ার ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসেও পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর জন্য তিনি কলম্বোতে মার্কিন দূতাবাসে ভিসার আবেদন জানালেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

মালদ্বীপ যাওয়ার আগের দিন পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন গোটাবায়া। এটি গতকাল বুধবার থেকে গৃহীত হওয়ার কথা। পদত্যাগপত্রটি স্বাক্ষর করার পর তিনি তার এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার কাছে দেন এবং তার মাধ্যমে এটি পার্লামেন্টের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনের কাছে পাঠান হবে। স্পিকার এ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন।

দেশজুড়ে গত কয়েক শতকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কারণে তীব্র চাপের মুখে গোটাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ করার এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা আগেই জানিয়ে দেন। এদিকে আগামী ২০ জুলাই পার্লামেন্টে গোপন ভোটে নতুন শীলঙ্কায় নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হবে। স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে জানিয়েছেন পার্লামেন্টে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে আগের দিন প্রার্থীদের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র জমা নেয়া হবে। এ লক্ষ্যে স্পিকার ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দলের নেতাদের পার্লামেন্টে ডেকেছেন। এদিকে শ্রীলঙ্কায় নতুন প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন, তা নিয়ে এরইমধ্যে শুরু হয়েছে দৌড়ঝাঁপ। আলোচনায় তিনজনের নাম শোনা যাচ্ছে এবং তারা হলেন রনিল বিক্রমাসিংহে, ডালেস আলাহাপেরুমা ও সাজিত প্রেমাদাস।

তবে যে প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন, তিনিই শ্রীলঙ্কার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন। শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখে গত ৯ জুলাই হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা জোর করে কলম্বোতে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সরকারি বাসভবনে ঢুকে নানা রকম কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা বিগত ৭০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। যে কারণে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধ আমদানি করতে দেশটিকে লড়াই করতে হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা শেষ হয়ে গেছে এবং ব্যক্তিগত যানবাহনের জন্য পেট্রোল এবং ডিজেল বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। জ্বালানির জন্য দিনব্যাপী দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

শ্রীলঙ্কার সংকট নিরসনে সর্বদলীয় নাকি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে তা নিয়ে চলছে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা। নজিরবিহীন বিক্ষোভ, সহিংসতা, তীব্র জ্বালানি ও আর্থিক সংকটের মধ্যে গোটাবায়ার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় আপাতত সমাপ্তি ঘটেছে রাজাপাকসে যুগের।

শ্রীলঙ্কার সামনে আপাতত কোনো সহজ রাজনৈতিক সমাধান নেই; বরং এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিক্ষোভে উত্তাল হলেও কোনো বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে না। একটি সর্বদলীয় সরকারের কথা বলা হলেও বিক্ষোভকারীরা তাতে রাজি নয়। তারা মনে করে, এতে করে রাজাপাকসের দলীয় ও পারিবারিক দুর্নীতিবাজ চক্রটি সর্বদলীয় সরকারে ঢুকে কূটকৌশলের আশ্রয় নেবে। কেননা তাদের দল শ্রীলঙ্কা পদুজনা পার্টি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নগুলোর নেতারা এ লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি প্রস্তুত করেছেন। তবে জাতীয়ভাবে পরিচিত কোনো বিকল্প নেতা এখনও পায়নি।

যে কারণে পতন রাজাপাকসেদের

চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জ্বালানি ও খাদ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ছিল রাজাপাকসে সাম্রাজ্যেরই আধিপত্য। সেই রাজাপাকসে পরিবারেরই একজন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়াকে কি না গতকাল বুধবার দিনের আলো ফোটার আগেই রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো।

দুই মাস আগেও তিনি বিক্ষোভকারীদের দাবি উপেক্ষা করে মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তা আর হলো না। গত শনিবার হাজার হাজার বিক্ষোভকারী তার সরকারি বাসভবন দখলে নিলে তিনি আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন, প্রতিশ্রুতি দেন ক্ষমতা ছাড়ার। গতকাল বুধবারই তার পদত্যাগ করার কথা ছিল। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই বলেন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের চারপাশে ইতস্তত হেঁটে বেড়ানো ৭৩ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মালাওয়ারা আরাচ্চি।

এই বাসভবনে সর্বশেষ ছিলেন গোটাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে, শনিবার থেকে এটি বিক্ষোভকারীদের দখলে। তারা জনগণের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। রাজাপাকসে পরিবার বিদায় নেয়ায় আমরা অদূর ভবিষ্যতেই বিশ্বের সেরা দেশ হব- বলেন তিনি।

মাহিন্দা গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান, ছেলে যোশিথ ছিলেন তার চিফ অব স্টাফ; বাবার সঙ্গে তারও বিদায় ঘটে। মাহিন্দার আরেক ছেলে নমল, বড় ভাই চমল, ছোট ভাই বাসিল আর শশেন্দ্রও গত এপ্রিলে মন্ত্রীত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল গত মঙ্গলবার দেশ ছেড়ে পালাতে চাইলে বিমানবন্দরে বাধার সমুখীন হয়েছিলেন। তাকে দেশের বাইরে যেতে দিলে জনসাধারণের ক্ষোভ আরও প্রকট হতে পারে আশঙ্কায় অভিবাসন কর্মকর্তারা তাকে যাওয়ার অনুমতি দেননি। তবে শেষ পর্যন্ত বাসিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গোটাবায়ার এই ছোট ভাই মার্কিন নাগরিক।

শ্রীলঙ্কার কাছে এখন জ্বালানি আমদানির জন্য ডলার নেই বললেই চলে। বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতা তাদেরকে ঋণখেলাপি বানিয়ে দিয়েছে। গত মাসেই তাদের মূল্যস্ফীতি ৫৪.৬ শতাংশ ছুঁয়েছে, সামনে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জ্বালানি বাঁচাতে দেশটিতে স্কুল আর অফিসও বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

১৯৪৮ সালের স্বাধীনতার পর আর কখনোই দেশটি এত বাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েনি, অথচ এর মধ্যে তারা তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধও পার করেছে; ২০০৯ সালে প্রতিরক্ষা সচিব থাকাকালে গোটাবায়াই তামিল বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ তদারকি করেছিলেন।

অবশ্য শ্রীলঙ্কার এখনকার এ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সবচেয়ে বেশি দায় কোভিড-১৯ মহামারির; বৈশ্বিক এ মহামারি দ্বীপদেশটির পর্যটন খাতের গলাটিপে ধরে, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহে নামে ধস।

পাশাপাশি রাজাপাকসেদের সরকারের কর কমানোর নীতি আর রাসায়নিক সারে নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা অবশ্য কয়েক মাস পরে তুলেও নেওয়া হয়েছিল, তবে যা ক্ষতি হওয়ার তা অতদিনে হয়ে গেছে, খাদ্য উৎপাদনে এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে।

সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে শ্রীলঙ্কার যে আলোচনা চলছে, তা থেকে ফল মিলতে এই বছরের শেষ বা আগামী বছরের প্রথম ভাগ লেগে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি কলম্বোকে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের কাছে আরও হাত পাততে বাধ্য করতে পারে।

মাহিন্দার পদত্যাগের পর দায়িত্ব নেওয়া প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেও এরই মধ্যে ‘সর্বদলীয় সরকারের স্বার্থে পদত্যাগের ইচ্ছা’ প্রকাশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই পদত্যাগ করলে সংবিধান অনুযায়ী স্পিকারকেই পার্লামেন্টে নতুন প্রেসিডেন্ট ঠিক হওয়ার আগের কয়েক দিন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে হবে। শ্রীলঙ্কা এখন অনিশ্চিত পথে, এ ধরনের অস্থিরতা আমরা কখনোই দেখিনি। প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী দুজনই যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে আমাদেরকে আরও দীর্ঘসময় অস্থিরতা দেখতে হতে পারে। এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি, তা হয়তো সামনে যা হতে পারে, তার তুলনায় কিছুই না- বলেছেন কলম্বোভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ভাবানি ফনসেকা।

গৃহযুদ্ধের নায়ক গণবিক্ষোভে উৎখাত

তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের পরাজিত করে তিন দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে একসময় ছিলেন জাতীয় বীর; তিনিই এখন দেশের সবচেয়ে ধিকৃত খলনায়ক। এক দশকের বেশি সময় শ্রীলঙ্কা শাসন করেছে রাজাপাকসে পরিবার, বৈরী সময় আর ভুল সিদ্ধান্তের বলি হয়ে ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। সেই দায় মাথায় নিয়ে প্রতাপশালী এই রাষ্ট্রনেতাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো প্রবল গণবিক্ষোভের মধ্যে।

কয়েক মাস ধরে টানা বিক্ষোভে গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে। বিক্ষোভকারীরা তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাদের জনপ্রিয় স্লোগান হয়ে উঠেছিল ‘গোটা, গো হোম’। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন গোটাবায়া রাজাপাকসে।

এর মধ্যে গত শনিবার রাজধানী কলম্বোতে রীতিমতো লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। ঝড়ো বিক্ষোভে হাজারো মানুষ গোটাবায়ার বাসভবনে ঢুকে পড়ে। খবর আসে, পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। গভীর রাতে তার পদত্যাগে রাজি হওয়ার খবর আসে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বুধবার ইস্তফা দেবেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। এরপর নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ২০ জুলাই পার্লামেন্টে ভোট হবে বলে জানান স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে।

মাহিন্দা রাজাপাকসেকে কেউ কেউ বলতেন সম্রাট, তিনিই তার ছোট ভাই গোটাবায়া রাজাপাকসেকে এনেছিলেন রাজনীতিতে, যিনি এখন পালিয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। মোটামুটি দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। দেশের েিপ্রসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী- দুই পদেই তিনি ছিলেন। গোটাবায়া রাজনীতির দৃশ্যপটে আসেন পরে, আর সেটা ভাইয়ের হাত ধরেই।

২১ বছর বয়সে গোটাবায়া শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দুই দশক সেখানে চাকরি করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন। সময়ের আগেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন।

২০০৫ সালে বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলে দেশের রাজনীতিতে গোটাবায়ার পদার্পণ ঘটে। সে সময় তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মাহিন্দা। স্বাধীনতাকামী লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলমের (এলটিটিই) দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের অবসান ঘটানোই ছিল তার মিশন।

শ্রীলঙ্কার উত্তরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে আসছিল তামিল টাইগার্সরা। অনেক সম্ভাবনার পরও শ্রীলঙ্কার লাভের গুঁড় খেয়ে নিচ্ছিল গৃহযুদ্ধ।

২৬ বছর ধরে সংঘাতের পর ২০০৯ সালে সরকারের অভিযানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এলটিটিই। জাতিসংঘের ধারণা, যুদ্ধের শেষ কয়েক মাসে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক তামিলও নিহত হয়েছিলেন।

তবে শ্রীলঙ্কা সরকার সে সময় বলেছিল, বিদ্রোহীরা হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়।

সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা গোটাবায়াকে যুদ্ধের নায়ক হিসেবে দেখেন। তবে অনেকে আবার তাকে হত্যা, নির্যাতন এবং সরকারের সমালোচকদের গুম করাসহ যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেন, যদিও সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গোটাবায়া।

২০১৫ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতা হারালে গোটাবায়াও পদত্যাগ করেন। কিন্তু ২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৫০ জনের মৃত্যুর পর ফের রাজনীতির মাঠে ফেরেন চরমপন্থার বিরুদ্ধে কঠোর হিসাবে পরিচিত রাজাপাকসে।

দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে না থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে মাহিন্দা সরে দাঁড়ালে রাজাপাকসের পরিবার ও শ্রীলঙ্কার পডুজানা পার্টির পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন গোটাবায়া।

জাতীয় নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্ম

২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর গোটাবায়া তার আগের সরকারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, গৃহযুদ্ধের সময় তার তৈরি করা একটি বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হয়েছে, যার ফল হিসেবে সংগঠিত হতে পেরেছে জঙ্গিরা। বোমা হামলার এক সপ্তাহ পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন ঘোষণার সময় রয়টার্সকে গোটাবায়া বলেছিলেন, আগের সরকার জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়নি। তারা জাতিগত মৈত্রীর কথা ও মানবাধিকারের কথা বলেছিল, তারা ব্যক্তি স্বাধীনতার কথাও বলেছিল।

২০১৯ সালের নভেম্বরের ভোটে বিপুল ব্যবধানে জয় পান গোটাবায়া। জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে গোটা শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিত্ব করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি মামলা দায়ের হলে তার প্রচারে সামান্য প্রভাব পড়েছিল। তার বিরুদ্ধে এক সাংবাদিককে অপহরণ ও খুনের অভিযোগ ছিল।

এছাড়া আরেক মামলায় তামিল সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও সেগুলোকে ভিত্তিহীন দাবি করেছেন গোটাবায়া।

২০২০ সালের আগস্টে পার্লামেন্টে গোটাবায়ার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেড়ে দুই-তৃতীয়াংশে উন্নীত হয়। প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদের সময়কালসহ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত করার আইন বাতিলের অনুমতি মেলে।

গোটাবায়া বড় ভাই মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরিয়ে আনেন এবং আত্মীয়দের মন্ত্রিপরিষদে জায়গা দেন, যার ফলে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে রাজাপাকসে পরিবারের প্রভাব পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু এত ক্ষমতাও বেশি দিন টিকল না।

করোনার মহামারির প্রভাব এবং শুল্ক কমানোর মাশুল শ্রীলঙ্কাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে হাজারো মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়।

জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রান্নার তেল-গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের সংকটে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের জীবন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। এই দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয় প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবারের ওপর।

দেশকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলার জন্য এপ্রিলের শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে এবং তার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে বিরোধীরা। মাহিন্দার পতনের পর প্রধানমন্ত্রী পদে পুরোনো মিত্র রনিল বিক্রমাসিংহেকে এনেছিলেন গোটাবায়া। এরপর তারও পদত্যাগ দাবি শুরু করে বিক্ষোভকারীরা।

থেমে থেমে চলা বিক্ষোভের মধ্যে শনিবার হাজারো বিক্ষোভকারী নিরাপত্তাকর্মী, পুলিশ, টিয়ারশেল ও ফাকা গুলি উপেক্ষা করে ঢুকে পড়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে। গোটা কলম্বোতে তৈরি হয় টালমাটাল পরিস্থিতি।

তার তিন দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো জনরোষ থেকে বাঁচতে, কারণ নতুন সরকার এলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে, এমনকি তামিল হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও আনা হতে পারে তার বিরুদ্ধে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত