ঢাকা বুধবার, ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অস্থির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অস্থির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যেকার সংঘাত-সংঘর্ষের বিষয়টি অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এক্ষেত্রে অনেকটাই মুক্ত ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিচ্ছিন্নভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসে তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না বললেই চলে। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য ছাত্ররাজনীতি শুরু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট মহলে চরম অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে।

সূত্রমতে, সম্প্রতি ৩৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করে ছাত্ররাজনীতি জোরদার করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কমিটি গঠনের টার্গেট রয়েছে তাদের। আগে থেকেই অপ্রকাশ্য তৎপরতা চলছিল ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের। নতুন করে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালানোর টার্গেট রয়েছে তাদেরও। এ নিয়ে অভিভাবক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্টেরও আশঙ্কা করছেন তারা। আর উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ না করার কথা জানালেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরইমধ্যে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি এড়ানোর বিষয়ে নোটিশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বাভাবিক ছাত্ররাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ। আর ছাত্রলীগের রাজনীতি অনুমতি দিলে অন্য সংগঠনগুলোও তাদের তৎপরতা বাড়াবে বলে আভাস দিয়েছে।

সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি জাহিদ হোসেন পারভেজ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর ছাত্রলীগের অন্যান্য শাখার ন্যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যক্রমের জন্য সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা গঠন করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত দুটি কমিটি দায়িত্ব পালন করে। সর্বশেষ গঠিত কমিটির মেয়াদ গত ৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মধ্যে শেষ হয়েছে। তবে এখনও নতুন কমিটি গঠিত না হওয়ায় আমরাই শাখার দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে প্রথম আমাদের কমিটি গঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের চতুর্থ কমিটি দায়িত্ব পালন করছে। নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ২০১৯ সালে আমরা বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালন করেছি। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনমতো কর্মকাণ্ড চালিয়েছি।

বর্তমানে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মাস্টার্সের ছাত্র জাহিদ হোসেন পারভেজ আরও বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ৩৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি ঘোষণা দিয়েছি। এরমধ্যে ২২টিতেই প্রথমবারের মতো কমিটি দেয়া হয়েছে। এরমধ্য দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের তৎপরতা আরও জোরদার করছি। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নোটিশ দিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে না জড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের ভবিষ্যৎ অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ কোনো বিধি-নিষেধের মধ্যে কখনও সীমাবদ্ধ ছিল না, আগামীতেও থাকবে না। আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার কাছে দায়বদ্ধ। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র মানেই শেখ হাসিনা। যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ তার কার্যক্রম চালাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তাদের কথা হচ্ছে। সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে গঠনমূলক ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে ছাত্রলীগ সক্রিয় থাকবে। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী ইউজিসি অনুমোদিত সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড চালানো হবে। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও প্রগতিশীল ধারার অন্য কোনো সংগঠনও যদি কার্যক্রম চালায়, তাহলে তাদের স্বাগত জানানো হবে।

সূত্রমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি সক্রিয় না থাকলেও অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের পাশাপাশি ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি দেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব ছাত্রসংগঠনও তাদের তৎপরতা জোরদার করবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আবু হানিফ বলেন, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির অনুমোদন না থাকায় অনেকে বাইরে আমাদের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি দেখে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈকত আরিফ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকাশ্য রাজনীতি এতদিন বন্ধই ছিল। সেজন্য নির্দিষ্ট বিদ্যালয়ের পরিবর্তে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির মাধ্যমে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের তৎপরতা চালিয়ে থাকি। কিন্তু ছাত্রলীগ বর্তমানে রাজনীতিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও কর্তৃপক্ষের আপত্তিও আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ওপেন রাজনীতির সুযোগ দেয়া হলে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস বা ঝামেলার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষায় প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।

এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সে ব্যাপারে সেই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মালিকদের সংগঠন-বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।

গত ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড ট্রাস্টির চেয়ারম্যানদের এবং উপাচার্যদের কাছে লিখিতভাবে এ মতামত পাঠায় সমিতি। এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন লিখিত মতামত জানান।

সমিতির লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়ে আমরা বিশেষভাবে অবগত। ট্রাস্টের অধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মূলত সেশনজটমুক্ত, অলাভজনক ও অরাজনৈতিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

গত ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যকে স্বাগত জানান।

সমিতি জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সচেতনতা ও সম্পৃক্ততাকে নিরুৎসাহিত করে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কি না তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম দ্বারা নির্ধারিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে উপাচার্যরা শান্তিশৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুন বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সহমত ও সন্তুষ্ট। ক্যাম্পাসের বাইরে ইতিবাচকতা রাজনীতির ধারায় অংশগ্রহণ করার বিষয় একান্তই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরাই ঠিক করবেন।

আমরা মনে করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পলিসি, শৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুন অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতি নিরুৎসাহিত করে এরইমধ্যে নোটিশ দিয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এই নোটিশগুলোতে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সতর্ক করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও উদ্বিগ্ন। একইভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাকদের মাঝেও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন, রাজনীতি বা ছাত্ররাজনীতি করা সবার অধিকার। শিক্ষামন্ত্রণালয় বা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনও এ রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে না।

এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ইউজিসি মূলত বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে। ইউজিসির আইনে সংগঠন করা না করা এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এখতিয়ার। যেহেতু আইনে কিছু বলা হয়নি সেহেতু এখানে ইউজিসি কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত