ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তাঁতী লীগ যেন দুর্বৃত্তদের আখড়া

তাঁতী লীগ যেন দুর্বৃত্তদের আখড়া

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ তাঁতী লীগ। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি আর শীর্ষ নেতাদের বয়সের ভারে যেন ন্যূব্জ হয়ে পড়েছে তাঁতী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। গতিহীন নেতৃত্বে তাঁতী লীগের বাতি যেন নিভু-নিভু জ্বলছে। তাঁত শিল্পের মতো যেন বিলুপ্তির পথে হাঁটছে সংগঠনটি। এছাড়াও জেলা-উপজেলার কমিটি গঠন নিয়েও বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। মহান স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় শোক দিবস ও মহান বিজয় দিবসের কর্মসূচির বাইরে তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় না তাঁতী লীগের নেতাকর্মীদের। তাঁতীদের মাঝেও নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি সংগঠনটি। এমনকি করোনাকালে দুস্থ তাঁতী ও অসহায় নেতাকর্মীদেরও খোঁজ রাখেনি সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। দুস্থ নেতাকর্মী ও অসহায় তাঁতীদের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে পাওয়া বরাদ্দের টাকাও নয়-ছয় হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, তাঁতী লীগের বর্তমান কমিটিতে জায়গা পেয়েছে দলছুট, সুবিধাবাদী, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত এবং বিএনপির রাজনীতি করা লোকজনও। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টি ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) নেতাকর্মীদেরও টাকার বিনিময়ে তাঁতী লীগে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ২১ জুলাই তাঁতী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘোষণার পরপরই বসন্তের কোকিলদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁতী লীগের সাবেক আহ্বায়ক এনাজুর রহমান চৌধুরী। এছাড়া ফ্রিডম পার্টি-পিডিপি, বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে তাঁতী লীগ থেকে বহিষ্কার করার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনেও মানববন্ধন করেছে সংগঠনের একটি অংশ। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে পিডিপি থেকে আসা তিনজনকে বহিষ্কার করে তাঁতী লীগ। 

তাঁতী লীগে আরও আশ্রয় নিয়েছে ভাড়াটে মামলাবাজ, হত্যা মামলার আসামি, বিতর্কিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি-২০০০ লি. এর লোকজনও। অর্থের বিনিময়ে ভাড়ায় খাটা মামলাবাজ আজিজুল হক পাটওয়ারীও রয়েছেন তাঁতী লীগের কমিটিতে। তাঁতী লীগের একজন শীর্ষ নেতার আস্থাভাজন হওয়ায় এক নম্বর সদস্য পদ দেয়া হয়েছে আজিজুল হক পাটওয়ারীকে।

অন্তত ৩০ জনকে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন শীর্ষ নেতারা। তবে কাদের এসব নেতা বানানো হয়েছে, নির্বাহী কমিটির সিনিয়র সদস্যরা তা জানেন না বলেও জানা গেছে। ডেসটিনি-২০০ লি. এর মতো বিতর্কিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে সৈয়দ তানভীর ইমাম যুবরাজ ও মুহিত নামে দুই ব্যক্তিকে তাঁতী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। তবে তারা কখনোই সাংগঠনিক কার্যক্রম ও দলীয় কর্মসূচিতে আসেন না। 

সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁতী লীগকে সংগঠিত ও সুদৃঢ় করার পরিবর্তে নিজ নিজ বলয়ে সংগঠনকে বিভক্ত করেছেন শীর্ষ তিন নেতা। জেলা-উপজেলার কমিটিতেও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করেনি। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত-অব্যাহতিপ্রাপ্তদেরও সংগঠনে জায়গা দিয়েছে তারা। বসন্তের কোকিলদের হাত থেকে তাঁতী লীগ রক্ষা কারার দাবিও জানিয়েছেন তারা।

সাংগঠনিক কার্যক্রমে ভাটা পড়লেও কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে। ৩০টির অধিক জেলায় কাউন্সিল না করেই ঘরে বসে কমিটি করারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এক জেলায় একাধিক কমিটি দিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগ তুলেছেন বর্তমান কমিটির কার্যকরী সভাপতি সাধনা দাশগুপ্তা। ইস্কাটনের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ অভিযোগ তোলেন। সংবাদ সম্মেলনে সাধনা দাশগুপ্তা বলেছেন, ‘তাঁতী লীগের বর্তমান সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. শতকত আলী ও সাধারণ সম্পাদক খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ বিভিন্ন জেলায় একাধিক আহ্বায়ক কমিটি করেছেন। মাত্র ৪-৫টি জেলায় তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পেরেছেন। একবার টাকা নিয়ে কমিটি দেয়, আবার কয়েক দিন পর তা বিলুপ্ত করে। আবার টাকা নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করে।

নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, শীর্ষ নেতাদের তিনজনের মধ্যে দুইজনই থাকেন ঢাকার বাইরে। এ কারণে তৃণমূলের কর্মীরা দেখা-সাক্ষাৎ পান না কেন্দ্রের শীর্ষ তিন নেতার। কমিটি গঠন করার পর থেকে তারা নিয়মিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসছেন না। এমনকি সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যৌথ সভায়ও নিয়মিত অংশ নেন না তারা।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালেও অসহায় তাঁতীদের কল্যাণে এগিয়ে আসেনি সংগঠনটি। করোনাকালে অসহায় কর্মী ও দুস্থ তাঁতীদের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেয়া ১০ লাখ টাকা ও দুই ঈদের ৪ লাখ টাকাও হেরফের করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। করেনাকালে দলীয় সহায়তা হেরফের করার অভিযোগ তুলে সাধারণ সম্পাদক খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পোস্টার ছাপায় তাঁতী লীগের অসহায় নেতাকর্মীরা। অর্থ তছরুপের বিষয়ে ৩ সদস্যের কমিটি হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে তাঁতী লীগের সাধারণ সম্পাদক খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথকে ফোন দিলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সংযোগ কেটে দেন।

পিডিপি ও ফ্রিডম পার্টির লোকদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁতী লীগের সভাপতি ইঞ্জিনিয়র শওকত আলী বলেন, এগুলো কি বলেন? আমরা জেনে-শুনে কি এদের নেব? যে তিনজনকে বাদ দেয়া হয়েছে তারা নেত্রীর (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে কি কথা যেন বলেছিলেন। পিডিপি ও ফ্রিডম পার্টির কারণে না। নেত্রীর বিরুদ্ধে মিছিল করেছিলেন। 

কমিটি বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, কোনো কমিটি তো কারণ ছাড়া ভাঙা হয় না। কমিটি করার ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের অভিযোগও সত্য নয়। আমার জীবনে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করিনি। এ ধরনের অভিযোগ আমার জানা নেই। বাড়িতে অফিস আছে, ঢাকায়ও অফিস করি। 

করোনাকালে ১০ লাখ টাকা হেরফের বিষয়ে তিনি বলেন, এই টাকা কোথায় খরচ করা হয়েছে, তার হিসাব রয়েছে। কিন্ত দুস্থদের এই টাকা দেয়া হয়নি। তবে আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক নয়। সাধারণ সম্পাদক এই টাকা পরে সংগঠনের কাজে খরচ করেছেন। সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে পোস্টার ছাপানোর ঘটনা সত্য।

চিঠি দিয়ে নেতা বানানোর বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তিনি স্বীকার করেন, খালি পদ দেয়া হয়েছে। যাদের চিঠি দিয়ে নেতা বানানো হয়েছে, তারা কর্মসূচিতে না আসলেও সাংগঠনিক কাজে যতটুকু সহায়তা করার দরকার তারা করেন। তারা ডেসটিনি করতেন এটা জানি না। 

সূত্র মতে, তাঁতী লীগের গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৬৫ সালে তাঁতী সমিতির মাধ্যমে। এরপর ১৯৮৯ সালে তাঁতী লীগের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাকালে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সোহবার উদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন সাধনা দাশগুপ্তাসহ অন্যরা। প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৯৫ সালের ২২ জুলাই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা লাভ করে সংগঠনটি। তার ২ বছর পর ১৯৯৭ সালে ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলীকে সভাপতি ও সাধনা দাশগুপ্তাকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি দেয়া হয়। এরপর ২০০৩ সাল পর্যন্ত নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে তাঁতী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। ২০০৩ সালে এসে ফের আহ্বায়ক কমিটি করা হয় তাঁতী লীগের। এনাজুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও সাধনা দাশগুপ্তা, খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথসহ অন্যদের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং  ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলীকে সদস্য করা হয়। ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ প্রথম আনুষ্ঠানিক কাউন্সিল হয় তাঁতী লীগের। সেখানে পুনরায় সভাপতি করা হয় ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলীকে। সাধারণ সম্পাদক করা হয় খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথকে। আর কার্যকরী সভাপতি করা হয় সাধনা দাশগুপ্তাকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত