জাতীয় সংসদ নির্বাচন

রাজনৈতিক অস্থিরতায় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সংস্কৃতি পুরোনো। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ব্যস্ত থাকে। ওই সুযোগে কথিত ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলো ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে। এমনই ‘হামলার’ সুযোগ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে প্রস্তুতি হিসেবে জঙ্গিরা একদিকে নতুন সদস্য সংগ্রহ করছে, অপর দিকে পার্বত্যাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ে ও দেশের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তারা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে গেরিলা হামলার। যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় ঘরছাড়া একদল তরুণ হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি জঙ্গি সংগঠনের বেশ কিছু সদস্যের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জানা গেছে, পুরোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে মাঠে নেমেছে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) নামের একটি নতুন জঙ্গি সংগঠন। সে সংগঠনে যোগ দিতে কতিপয় কিশোর-যুবক বাড়ি ছাড়ার তথ্য পাওয়ার পর তদন্তে নামে একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রাপ্ত তথ্যে এ সংখ্যা অর্ধশতাধিকেরও বেশি। দেড় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ এসব তরুণ। দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি উদ্বেগ ও আশঙ্কার মনে করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, এই মুহূর্তে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এটিবি)’ ও নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) নামের সংগঠন দুটি। এর মধ্যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে দুর্গম অঞ্চলে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় আত্মগোপনে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এরইমধ্যে রাজধানী ছাড়াও দেশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং প্রত্যন্ত চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলা থেকে দফায় দফায় একাধিক জঙ্গি সংগঠনের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। নাশকতার পরিকল্পনায় ‘নিরুদ্দেশ জঙ্গি’ গ্রেপ্তারে প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বছরখানেক বাকি। এরই মধ্যে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও দুইপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া কিংবা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে জঙ্গিরা তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চালাতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যস্ততার সময় জঙ্গি সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করে এবং কিছু ঘটানোর চেষ্টা করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনসহ (ইভিএম) কয়েকটি ইস্যুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। সংকট নিরসনে দুই দলের আলোচনা বা সংলাপের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং দিন যতই গড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে দূরত্ব ততই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

তাদের ভাষ্য, আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি ব্যস্ত থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর ওই সুযোগটাই বেছে নিতে চায় জঙ্গিরা। এরই অংশ হিসেবে ক্লোজড গ্রুপের মাধ্যমে তরুণদের ‘মগজধোলাই’ করছেন জঙ্গি নেতারা। র‍্যাব বলছে, চার ধরনের পরিবেশ চিহ্নিত করে গেরিলা যুদ্ধ কিংবা গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে উগ্রবাদে জড়িয়েপড়া ব্যক্তিরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে ঘরছাড়া সেসব তরুণও। বনভূমি, পাহাড়ি ভূমি, মরুভূমি ও জলাভূমি; এই চারটি এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান বিভিন্ন তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। বাংলাদেশে মরু অঞ্চল না থাকলেও মরুভূমিতে যুদ্ধ করাটা কষ্টসাধ্য। আর আল-কায়েদাসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি সংগঠন মরুভূমিতে যুদ্ধ করেছে। এটা এখানকার জঙ্গিরা একটি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে সে ধরনের প্রস্তুতির চেষ্টা করেছে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে জঙ্গিরা নিজেদের সদস্যদের বিভিন্ন আক্রমণের কলাকৌশল, বোমা তৈরির কৌশল ও এককভাবে হামলার কৌশল সম্পর্কে বেশি প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। যারা জামিনে বেরিয়ে আসছেন তাদের টার্গেট করেও সিক্রেট গ্রুপে জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। জঙ্গিদের আকার-ইঙ্গিত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, জঙ্গিরা তাদের সদস্যদের বলছে- প্রস্তুতি নিতে, দাওয়াত দিতে এবং গ্রাউন্ড তৈরি করতে।

সিটিটিসি সূত্রে আরও জানা যায়, আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক ও অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থায়ন করা হচ্ছে। রাজধানীর দক্ষিণখানের কাঁচাবাজার এলাকার প্রান্তিক মিডিয়ার স্বত্বাধিকারী রেজাউল আলম ওরফে টিংকু নামে একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বিকাশ ও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়নের তথ্য মিলেছে।

এদিকে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করেছে র‍্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ তরুণের নাম-পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে বিদেশে রয়েছেন বলে জানেন পরিবার-স্বজনরা। তারা মাঝে মধ্যে বাড়িতে টাকাও পাঠান।

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। দেশে জঙ্গি নির্মূল হয়নি তবে নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক নিখোঁজদের বড় ধরনের কোনো টার্গেট থাকতে পারে। সম্প্রতি বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জঙ্গি হামলার বড় টার্গেট ছিল। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলাসহ বেশকিছু হামলার পরিকল্পনা তারা করেছিল। ২০২৩ সালে কিছু জায়গায় হামলার টার্গেট তাদের ছিল।

তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা সহিংসতায় অংশ নেয়ার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সংগঠনের যারা উচ্চ পর্যায়ে নেতৃত্বে রয়েছে তাদের নির্দেশনা পেলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের যে কোনো জায়গায় নাশকতার প্রস্তুতি তারা নিচ্ছিল। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে, আমরা সজাগ রয়েছি। আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি এস এম রুহুল আমিন বলেন, নিখোঁজ তরুণদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা না যাবে ততক্ষণ কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়।

সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই। তবে নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ সবাই নির্বাচনমুখী হয়ে যায়। নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতির যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সার্বক্ষণিক কাজ করে।