চলমান এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনের বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হেয় করার পাশাপাশি অসংখ্য বানান ভুলের অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। ভুল প্রশ্নের কারণে এবার কারিগরি বোর্ডের একটি পরীক্ষা চলার মাঝপথে বন্ধ করে দেয়া হয়। এর মাস দেড়েক আগে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায়ও প্রশ্নে ভুল, পরীক্ষার হলে ভুল প্রশ্ন সরবরাহ ও ফাঁসের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
শুধু এবছরই নয় এর আগেও বিভিন্ন সময়ে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নে নানা ভুল ও বিতর্কের ঘটনা ঘটে। এতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষাগ্রহণ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ও অদক্ষতার পাশাপাশি নৈতিকতা নিয়েও নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ভুল প্রশ্ন বা অন্যান্য বিতর্কিত ঘটনায় তাৎক্ষনিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা জানানো হলেও তাতে পরিস্থিতির কোন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। বরং প্রায় প্রতিবছরই পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দিচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রশ্নপত্রের ভুলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অদক্ষতা ও অসতর্কতার বিষয়টি প্রকাশ পায়। একইসঙ্গে প্রশ্নপ্রণয়নে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ও তদারকিতে ত্রুটি হলে শিক্ষাবোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও দায়-দায়িত্ব আছে। আগামীতে প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক এড়াতে আরও সতর্কতা ও কঠোরভাবে দেখার আশ্বাস দেন তিনি। এছাড়া সম্প্রতি এইচএসসির প্রশ্নে ভুল ও উসকানিমূলক তথ্যের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের আলোকে শিগগিরই জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে জানান আন্ত:শিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান।
সূত্রমতে, গত ৬ নভেম্বর সারা দেশে ৯ টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে একযোগে ২০২২ সালের এইচএসসির বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন ঢাকা বোর্ডের ১১ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নে সনাতন ধর্মের দুই ভাইয়ের জমি নিয়ে বিরোধের বিষয় তুলে ধরা হয়। যা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
প্রশ্নে বলা হয়, ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’
বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষার পরই আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সরকার যেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, এই প্রশ্ন তার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, সেই প্রশ্ন ওঠে। বিষয়টি দুঃখজনক হিসেবে বর্ণনা করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, কী কী বিষয় মাথায় রেখে প্রশ্ন করতে হবে, তার স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া থাকে শিক্ষকদের। সাম্প্রদায়িকতার কিছু যেন না থাকে, সেটাও সেই নির্দেশিকায় আছে। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন মন্ত্রী।
পরে ওই প্রশ্ন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচ শিক্ষককে চিহ্নিত করে যশোর বোর্ড। এ ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করে বোর্ডটি। সূত্রমতে, বাংলা প্রথমপত্রের বিতর্কিত প্রশ্নপত্রটি প্রণয়ন করেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। সেটি মডারেট করেন নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দিন শাওন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শফিকুর রহমান, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক রেজাউল করিম। সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক এ প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই একইদিনের কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা দ্বিতীয়পত্রে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক আনিসুল হককে নিয়ে অপমানজনক একটি সৃজনশীল প্রশ্নের তথ্য ধরা পড়ে। এ নিয়েও বিতর্কের এক পর্যায়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খান বলেন, বাংলা প্রশ্নে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হককে হেয় করার অভিযোগটি আমাদের নজরে এসেছে। বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নের পা-ুলিপি এনে প্রশ্ন প্রণেতা ও মডারেটরদের চিহ্নিত করা হবে। ইতোমধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আজ থেকে কমিটি কাজ শুরু করবে। ওই সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দীপকে লেখক আনিসুল হকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ করেন তিনি। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।’ সেই অনুচ্ছেদের নিচে ৫টি প্রশ্ন করা হয়েছে- (ক) ‘যশ’ শব্দের অর্থ কী? (খ) ‘লেখা ভালো হইলে সুনাম আপনি আসিবে।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা কর। (গ) আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ, তা ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার আলোকে ব্যাখ্যা কর। (ঘ) সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনায় লেখকের পরামর্শ বিশ্লেষণ কর।’ পাবকিলক পরীক্ষায় সাম্প্রদায়িক উসকানি, হেয়করা ও নানা ভুলে ভরা এমন প্রশ্ন দেখে হতবাক হয়ে পড়েছেন অভিভাবকসহ দেশের সচেতন নাগরিকরা। তাদের মতে, সৃজনশীল প্রশ্নের মাধ্যমে হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে। বিতর্কিত প্রশ্নপত্রগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে এমন উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে অভিভাবকদের মাঝে। এছাড়া, প্রশ্নপত্র ত্রুটির কারণে প্রথমদিন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা-১ (নতুন ও পুরাতন সিলেবাস) পরীক্ষাটিও মাঝপথে স্থগিত করা হয়। এঘটনায় দেশ জুড়ে নানা বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম বোর্ডের ৪০ নম্বরের বাংলা প্রশ্নে ৪১টি বানান ভুল: সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রশ্ন ও কথা সাহিত্যিক আনিসুল হককে হেয় করার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই চট্টগ্রাম বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের ৪০ নম্বরের সৃজনশীল প্রশ্নে ৪১টি বানান ভুল পাওয়া গেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ গণমাধ্যমকে বলেন, একটি প্রশ্নে এতগুলো ভুল কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যারা এই প্রশ্ন তৈরি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রশ্নের বানানা ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ আমীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, চট্টগ্রাম বোর্ডের বাংলা (আবশ্যিক) সৃজনশীল (প্রথমপত্র) ৪০ নম্বরের প্রশ্নপত্রে ৪১টি ভুল/অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ এবং বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকা অনুসারে ভুল/অসংগতিসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রশ্নেও নানা ভুল, পরীক্ষার হলে ভুল প্রশ্ন সরবরাহ, প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। উদ্ভুত পরিস্থিতি একাধিক পরীক্ষা স্থগিত করে নতুন শিডিউল ও প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়। সূত্রমতে, এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে অনেক বানানই ভুল ছিল। ভুলে ভরা এ প্রশ্নেই ওই দিন ২০ লাখ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়।
এ ভুলের বিষয়ে তাৎক্ষনিকভাবে রাজধানীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাধিক বাংলা শিক্ষক বলেন, যত্ন নিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র প্রণেতাদের চরম গাফিলতি ছিল। এমনকি মডারেশনের সময়ও এসব ভুল ধরা পড়ার কথা। এ ক্ষেত্রে যারা মডারেশন করেছেন তারাও একইভাবে গাফিলতি করেছেন। তারা বলেন, এর আগের বছরও বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্রে ভুল ছিল। কারও কোনো শাস্তির উদাহরণ না থাকায় বছরের পর বছর ভুলে ভরা প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, শুধু প্রশ্নপত্র প্রণয়ন বা মডারেশন নয়, একইভাবে পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনেও একশ্রেণির শিক্ষক অহরহ গাফিলতির পরিচয় দেন। তারা ভুল প্রশ্ন বিতরণ করেন, আবার কেউ দেন দেরিতে প্রশ্নপত্র। কোনো নিয়মনীতিই তারা মানতে চান না। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এ কারণে যশোর শিক্ষা বোর্ডের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ওই পরীক্ষার প্রথম দিন নড়াইলের কালিয়ার একটি কেন্দ্রে বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার সময় দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্র (এমসিকিউ) বিতরণ করার কারণে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। এতে পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয় বোর্ড কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকদের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে নতুন করে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নিতে হয় সরকারকে। এ বছর এসএসসির প্রথম দিনে ঝিনাইদহের শৈলকুপা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১৫ মিনিট দেরিতে প্রশ্ন বিতরণ করা হয়। এ ঘটনায় পরীক্ষার্থীরা অভিযোগ করলে কেন্দ্র সচিব ওই দুই কক্ষ পরিদর্শককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। যদিও কেন্দ্র সচিব জানিয়েছিলেন, ১৫ মিনিট নয়, ৫ মিনিট পরে ২০৪ নম্বর কক্ষে প্রশ্ন বিতরণ করা হয়।
এ বছর কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে শিক্ষকদের মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিবের কক্ষে পরীক্ষার আগেই প্যাকেট খোলা প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ওই বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার পাশাপাশি দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। কমিটির রিপোর্টে প্রশ্ন ফাঁসে শিক্ষকদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়।
এ ঘটনায় তাৎক্ষনিকভাবে কেন্দ্র সচিব ও শিক্ষকসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাময়িক বরখাস্ত করা হয় কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানকে। এ ছাড়া প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দিনাজপুর বোর্ডের ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র বাতিল এবং চারটি বিষয়ের পরীক্ষার নতুন শিডিউল ঘোষণা করা হয়। পরে জড়িত ছয় শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।
এবারের এইচএসসি সহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নে ভুল ও বিতর্কিত বিষয় কারণ প্রসঙ্গে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট মাস্টার ট্রেইনার শিক্ষকদের তালিকা থেকে বাছাই করা হয়। সংশ্লিষ্টদের ওরিয়েন্টেশন শেষে ও নির্দেশনার আলোকে প্রশ্ন তৈরি করেন শিক্ষকরা। পরে তা মডারেশন করা হয়। এতে কোন ব্যত্যয় হলে বা অসতর্কতা ও দায়িত্বে অবহেলা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রশ্ন তৈরিকে বোর্ড কর্মকর্তারা তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া প্রশ্নকারী নিয়োগের দায়িতা তাদের। এক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষক বাছাইয়ে ঘাটতি বা কোন ত্রুটি হলে অবশ্যই তাদের দায় আছে। আগামীতে এ বিষয়গুলো আরও কঠোরভাবে দেখা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. তেলাওয়াত হোসেন খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে কোন পক্ষপাতিত্ব করলে হবে না। দক্ষরা সাধ্যমত তাদের মেধা দিয়ে কাজ করবেন। এতে ভুল-ভ্রান্তির আশঙ্কা কমবে। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁস, উসকানিমূলক প্রশ্ন প্রণয়ন বা কোন অনৈতিক কর্মকান্ডে শিক্ষকদের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও আহবান জানান তিনি। জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর পড়াশুনার পরিবর্তে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু কতটা আত্মস্থ করতে পারছে তা যাচাই করতে ২০০৮ সালে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমিক স্তরে সনাতনি পদ্ধতির পরিবরর্তে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে সরকার। এ পদ্ধতিতে একটি উদ্দীপক দিয়ে সেখান থেকে চারটি প্রশ্ন করা হয়। এতে চিন্তার দক্ষতার বিভিন্ন স্তর যেমন জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, তুলনা ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়। বিষয়বস্তু বুঝে বুদ্ধি খাটিয়ে যৌক্তিকভাবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর করা যায়। এ পরীক্ষাপদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো। ওই সময় বলা হয়েছিল, সৃজনশীল পদ্ধতিতে নোট-গাইড থাকবে না, কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যাবে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব ছিল শিক্ষকদের। কিন্তু শুরুর দিকে তাদের মধ্যে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও প্রশ্নপত্র তৈরিতে সহায়ক বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এতে কোচিং-প্রাইভেট বা গাইড বইয়ের উপর আরও নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় শিক্ষার্থীদের। মূলত সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে দুর্বোধ্যই রয়ে গেছে। এদিকে আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এতে নতুন বই ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। তবে বাস্তবে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে নৈরাজ্য বন্ধের আহ্বান ২৪ বিশিষ্টজনের: পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ‘নৈরাজ্য’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন ২৪ বিশিষ্টজন। শুক্রবার এক বিবৃতিতে তারা এ আহবান জানিয়ে তারা বলেন, সম্প্রতি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও কারিগরি স্তরের পাবলিক পরীক্ষার সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক, নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং একজন লেখকের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত ও অবমাননাকর প্রশ্ন সংযোজনের ঘটনা ঘটেছে। এটি অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত, কোনো অবস্থাতেই এসব মেনে নেওয়া যায় না।
বিবৃতিদাতারা বলেন, সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে সৃজনশীল হয়ে উঠতে হবে। সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, নারীর প্রতি অবমাননাকর, ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রশ্নপত্র শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও আধুনিকতাবিরোধী প্রবণতার চিত্র উঠে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও মডারেশন বোর্ডের সদস্যদের যোগ্যতা ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার পাশাপাশি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবার সময়ও এসেছে। পাশাপাশি মৌলবাদী একটি গোষ্ঠী বিজ্ঞানশিক্ষার পঠন-পাঠন থেকে চার্লস ডারউইনের যুগান্তকারী বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বাদ দেওয়ার যে দাবি তুলেছেন, তা-ও আমাদের বিচলিত করছে। এসব বিষয় দেশে বিজ্ঞানশিক্ষা ও মুক্তচিন্তার প্রসার বাধাগ্রস্ত করবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্র ও সমাজকে অন্ধকার, সাম্প্রদায়িকতা আর কূপমণ্ডূকতায় ঠেলে দেবে। বিবৃতিদাতারা হলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সুলতানা কামাল, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, রাশেদা কে চৌধূরী, রামেন্দু মজুমদার, ডা. সারওয়ার আলী, নুর মোহাম্মদ তালুকদার, রানা দাশগুপ্ত, খুশী কবির, এম এম আকাশ, এস এম এ সবুর, রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ।