স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালালেও বাংলাদেশের মানুষের ওপর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। একইসঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির অবস্থা নাজুক করে দিয়েছেন। সেই নাজুক অর্থনীতি টেনে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা আর চরম ডলার সংকট দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সেই প্রচেষ্টার বিশাল প্রাপ্তির কারিশমা দেখিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে প্রায় পৌনে সাত বিলিয়ন ডলারের অর্থ জোগাড়ের প্রাথমিক সাফল্য দেখিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই বড় অঙ্কের ডলার পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন। ফলে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর নোবেলজয়ীর হাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব থাকায় এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় এবারের অধিবেশন ছিল বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশকে ওই তাৎপর্যের আলোয় আলোকিত করেছেন। তার তিন দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে দীর্ঘদিনের বন্ধু মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও কূটনৈতিকদের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকসহ অন্তত ৪০টি অনুষ্ঠান করে বিশ্ববাসীর চোখের মণি হয়ে ওঠেন ড. ইউনূস। তার বিরল নেতৃত্বে বিশ্বমঞ্চে গৌরবের আসনে বাংলাদেশ।
গত শুক্রবার নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফ্লাইটটি আজ বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৫ মিনিটে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।
দূতাবাস ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তথ্যমতে, তিন দিনের এ সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রুটে শুফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি, মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রী, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টসহ আরো কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। এছাড়া চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্ববৃন্দ, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর করিম এ এ খান, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ৯টি মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সুশাসন নিশ্চিতে তার সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপ বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে জাতিসংঘের ৭৯তম আসরে যোগ দেন ড. ইউনূস। এবারের অধিবেশন ছিল ইউনূসময়। তার বিরল নেতৃত্বে গৌরবের আসনে ছিল বাংলাদেশ। ৫৪ বছরের ইতিহাসে যা ঘটেনি এবার এমন সব ঘটনাই ঘটছে। সব প্রটোকল ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসেন ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। যা শুধু বাংলাদেশের জন্য গৌরবের নয়, ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয়ও বটে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় চীন : গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় বিকালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনি বলেন, চীন-বাংলাদেশে সোলার প্যানেলে বিনিয়োগ এবং ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করতে চায়।
আইএমএফের ঋণ দেয়ার আশ্বাস : ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে স্বাগত জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা। একইসঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও অন্যান্য খাতে আইএমএফ আরও ঋণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। সেজন্য বাংলাদেশে একটি টিম পাঠিয়েছে সংস্থাটি। টিমের প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ঋণ কর্মসূচি আরো বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছে এ সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার সমর্থন ব্যক্ত করেন।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তা : বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া নানা সংস্কারের পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি জানিয়েছে, অর্থনৈতিক সংস্কার, ডিজিটালাইজেশন, তারল্য, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে সংস্কারের জন্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়া হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গ বুধবার নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় দুপুরে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দেবেন বলে জানান। বৈঠকে ড. ইউনূস তার নেয়া সংস্কার কাজের জন্য বিশ্বব্যাংকের আরো সহায়তা চান।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন, বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকসহ সার্বিক বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, পুরো বিশ্ববাসী নতুন এক বাংলাদেশ দেখেছে। পুরো অধিবেশনজুড়ে ড. ইউনূস বন্দনা ছিল। এটা সম্ভব হয়েছে বিশ্বব্যাপী তার খ্যাতি ও সুনামের কারণে। তার ব্যক্তিগত সুনামগুলো এখন দেশের কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। এটা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যার বৈঠক হচ্ছে, সেখানে অর্থনৈতিক সহায়তা ও বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের পাশে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য ২০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সংস্কারের যে কোনো উদ্যোগে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা নিঃসন্দেহে একটি প্রাথমিক সাফল্য। কারণ এখনো আমাদের কাঙ্ক্ষিত রিজার্ভ বাড়ছে না। কাজেই রিজার্ভ বাড়াতে হবে। তা না হলে মুদ্রা অবমূল্যায়িত হবে। এতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আমদানি কমে যাবে। ফলে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে। এর প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। এমন পরিস্থিতিতে বড় অঙ্কের ডলার যদি আমরা আনতে পারি, তা অবশ্যই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসংঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিশিষ্টজনরা উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখান। এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে তারা নতুনভাবে চিন্তা করবেন। তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের খ্যাতি ও ইতিবাচক ইমেজকে মূল্যায়ন করেই সাড়া দিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবার বৈঠক হয়। এরই মধ্যে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে আইএমএফ। এরপরও সংস্থাটি ড. ইউনূসের নেতৃত্বের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরো তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চায়। আইএমএফ মনে করে, একটি বিশেষ সময়ে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার অনেক খাতে সংস্কার করবে।
গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব জানান, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন করে পুনর্গঠন করার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তার মাধ্যমে সব জাতি ও রাষ্ট্রের অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে। এই ধরনের ইতিবাচক বক্তব্য ড. ইউনূসকে গ্লোবাল কণ্ঠস্বরে রূপান্তর করেছে। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। আ স ম আবদুর রব বলেন, বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আগামীতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জোগাবে- ড. ইউনূসের এই বক্তব্য ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানকে মহিমান্বিত করেছে। যা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
প্রসঙ্গেত, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিন দিনের সফর শেষে গতকাল শুক্রবার ঢাকার পথে রওনা দেন তিনি। এবার তার সফরসঙ্গীর সংখ্যা সব মিলিয়ে ৫৭ জন ছিল। বিশ্বজুড়ে সংঘাত নিরসনের প্রধান লক্ষ্য সামনে রেখে জাতিসংঘের অধিবেশন ১০ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিশ্ব নেতাদের মিলনমেলা শেষ হবে ৩০ সেপ্টেম্বর।