ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাড়ছে তিস্তার পানি

রংপুরসহ পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

রংপুরসহ পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

গত কয়েকদিনের অতিভারি বৃষ্টিতে তিস্তার পানি বিপৎসীমার উপরে ওঠার সঙ্গে অন্যান্য নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ : পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সিরাজগঞ্জের যমুনার পানি হু হু করে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার ও কাজিপুর পয়েন্ট ৫১ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে যমুনা নদীর অভ্যন্তরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (হেডকোয়ার্টার) নাজমুল হোসাইন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিন ধরে দফায় দফায় প্রবল বর্ষণে যমুনা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যমুনার অভ্যন্তরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শহরের হার্ড পয়েন্টে যমুনার পানি ৩৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৩ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং কাজিপুর পয়েন্টে ৫১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৩ দশমিক ১৬ মিটার নিচ প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে যমুনার অভ্যান্তরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে ও হচ্ছে। বিশেষ করে শাহজাদপুর ও কাজিপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। যমুনার পানি ২-৪ দিন বাড়তে পারে। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কুড়িগ্রাম : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে কুড়িগ্রামের ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে রংপুর জেলার কাউনিয়া রেল সেতু পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে তিস্তার তীরবর্তী রাজারহাট উপজেলার

ঘড়িয়ালডাঙ্গা, বিদ্যানন্দ, উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া, বজরা, থেতরাই, গুনাইগাছ এবং চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের আংশিক অংশ। এসব ইউনিয়নের চর ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৪ শতাধিক পরিবার, গ্রামীণ কাঁচা সড়কসহ ১৫৯ হেক্টর জমির রোপা আমন এবং মৌসুমী ফসলের খেত নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ জানায়, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বৃদ্ধি পেলেও তা বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামীকাল পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান।

কুড়িগ্রাম কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, তিস্তা নদীর অববাহিকায় ১৫৯ হেক্টর রোপা আমন, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি পেলে এর পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। রাজারহাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এবং কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে ফোন দিলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। লালমনিরহাটে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে, পানিবন্দি কয়েক হাজার পরিবার

লালমনিরহাট : পাহাড়ি ঢল আর কয়েক দিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে রোববার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে জেলার ৫টি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের অনেক বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার কয়েক হাজার পরিবার। এদিকে, পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোও ঝুঁকিতে পড়েছে। নতুন করে বন্যা ও ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে নদীপাড়ের মানুষজন।

গতকাল রোববার সকাল ৬টা হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ১৭ মিটার। যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে সকাল ৯টায় একই পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত রেকর্ড করা হয়।

এর আগে শনিবার দুপুর থেকে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হয়। ফলে নদী তীরবর্তী অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত শুরু হয়। লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার পরিবার। আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে তিস্তাপাড়ের এসব মানুষ।

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও চরবাসী জানায়, ভারতের সিকিমে উৎপত্তিস্থল থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। নদীর বাংলাদেশ অংশের উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা পানি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ফারাক্কা গেট খুলে বাংলাদেশ অংশে ছেড়ে দেয়া হয়। একইভাবে শুষ্ক মৌসুমে গেট বন্ধ করে বাংলাদেশকে মরুভূমি করে। তিস্তার পানি এককভাবে ব্যবহার করছে ভারত সরকার।

উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে তিস্তার পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বর্ষাকাল শুরু হলেই তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয় পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে। টানা কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ আরও বেড়েছে। নদী তীরবর্তী এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট বিৃজ কালভার্ট ভেঙে গেছে পানির তোরে। উৎতি আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরে মাছ। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। বাঁধ ভেসে যাওয়ায় শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ভাটিতে থাকা শত শত পরিবার।

সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ এলাকার পনির উদ্দিন (৭০) বলেন, রাতে পানির গর্জনে ঘুমাতে পারিনি। সলেডি স্প্যার বাঁধে ব্রিজ অংশের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এসময় বাঁধ কাঁপছিল। আমরা ভয় পেয়েছিলাম, স্প্যার বাঁধ বুঝি ভেসে যায়। স্থানীয়রা রাত জেগে বাঁধে বস্তা ফেলে রক্ষা করেছে। বন্যার সময় নির্ঘুম রাত কাটে তিস্তাপাড়ের মানুষদের।

আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইসলাম মিয়া বলেন, দুই রাত থেকে তিস্তা নদীতে পানি বাড়ছে। আমাদের গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। নৌকা দিয়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির যোগাযোগ করতে হচ্ছে। ডুবে থাকা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এ নিয়ে চিন্তায় পড়েছি। আমন খেত ডুবেছে বন্যায়। বেশি সময় এমন থাকলে ধানগাছ নষ্ট হতে পারে। একই গ্রামের হারুন মিয়া বলেন, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হাঁটু পানি। বাচ্চা বৃদ্ধদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে পড়েছি। এবারের বন্যায় তেমন কেউ খবর নিতেও আসেনি।

হাতীবান্ধা উপজেলার পশ্চিম বিছনদই গ্রামের তমিজ উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামে আড়াই/তিন শত পরিবারের বসবাস। সবাই শুক্রবার রাত থেকে পানিবন্দি। দিন যত যাচ্ছে পানিবন্দির সংখ্যা তত বাড়ছে। বন্যার সময় শিশু বৃদ্ধ আর গবাদি পশুপাখি নিয়ে বড় বিপদে পড়তে হয়। বন্যা হলেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তিস্তাপাড়ের মানুষদের। আমরা ত্রাণ নয়, চাই তিস্তার মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন।

ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে তিন/সাড়ে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। শুকনো খাবার এখন পর্যন্ত বরাদ্দ আসেনি। বরাদ্দ এলে পৌঁছে দেয়া হবে।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ হোসেন বলেন, আমাদের ইউনিয়নের তিন হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাঁধগুলো রক্ষায় সাধারণ মানুষদের নিয়ে বস্তা ফেলে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনিল কুমার বলেন, রোববার সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ বেড়ে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হয়। ফলে তিস্তাপাড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, কিছু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তাদের জন্য ত্রাণসামগ্রী খুব দ্রুত পৌঁছে দেয়া হবে। একই সঙ্গে যাতে বাঁধ বা সড়ক ভেঙে নতুন এলাকা প্লাবিত না হয়। সেটা নজরদারি করে এরইমধ্যে জিও ব্যাগ দিয়ে তা রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। বন্যা মোকাবেলা করতে জেলা, উপজেলা প্রশাসন আমরা প্রস্তুত রয়েছি বলেও জানান তিনি।

নীলফামারী : উজান থেকে নেমে এবং টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পুনরায় তিস্তা নদীর পানি বেড়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পাউবো কর্তৃপক্ষ। গত কয়েকদিন ধরে পানির প্রবাহ ওঠানামা করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায় গত মাসে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে হঠাৎ বন্যার সময়েতিস্তা নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক ছিলো। গত চারদিন ধরে পানির প্রবাহ বাড়তে থাকে। ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের কালীগঞ্জ, পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেশ্বর, খগারচর, জুয়ার চর, বাংলা পাড়া, উত্তর খরী বাড়ী, বাইশপুকুর ও জলঢাকা উপজেলার ফরেস্টের চড়, ডাউয়াবাড়ী, ভাবনচুর এলাকায় পানি ওঠানামা করছে।

পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল সরকার জানান, বন্যা বিষয়ে সজাগ রয়েছেন। পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আব্দুল লতিফ খান জানান, পানি শুরু হলেই নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়, এবারও বন্যার পূর্বাভাস দেখা দিয়েছে, আমি সর্বক্ষণ নৌকায় গিয়ে গিয়ে প্লাবিত এলাকার বাসিন্দাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করা হয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি রয়েছে। ডালিয়া বিভাগীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশফাউদ্দৌলা বলেন, রোববার সকালে পানির প্রবাহ ৫২.১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকাল ৩টায় পানির প্রবাহ ৫২.৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মানুষকে সচেতন করছি এবং কোথাও সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধান করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তুত রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত