ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কাল থেকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে

কাল থেকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে

পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে চলেছে পলিথিন। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও, কার্যকর প্রয়োগের অভাবে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, কাল থেকে সুপারশপে পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বলছে, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সেই হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ২ দশমিক ৫ কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। প্লাস্টিক দূষণে অবদান রাখা দেশেগুলোর মধ্যে শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্লাস্টিকের ব্যাগ দ্বারা অবরুদ্ধ নিষ্কাষণ ব্যবস্থাকে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে নগর বন্যার একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জানা গেছে, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ও অভিযানের খবরে তালিকাভুক্ত পাটের ব্যাগ প্রস্তুতকারী কোম্পানি সোনালি আঁশের শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এমনকি কোম্পানিটির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ কারণে লেনদেনের শীর্ষে উঠে এসেছে কোম্পানিটির শেয়ার।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সুপারশপে পলিথিন নিষিদ্ধের কথা জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে।

গবেষকদের মতে, পলিথিনের কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলীসহ দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি দূষিত হয়েছে। পলিথিন মাটির ব্যাপক দূষণ ঘটায় গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। পলিথিনের অতি ক্ষুদ্র কণা প্রতিদিন মানুষের পেটে যাচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে কঠোর অভিযান চালানো হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা, জেল ও জরিমানা করা হবে।

জানা গেছে, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ বন্ধে দেশে ২০০২ সালে আইন করা হয়। আইনে বলা আছে- পলিথিনের শপিং ব্যাগ বা অন্য যে কোনো সামগ্রী, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, সেসব উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, পরিবহন ইত্যাদি নিষিদ্ধ। এর পরেও পলিব্যাগের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চললেও উৎপাদন ও সরবরাহ কমেনি। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিবেশ অধিদপ্তরে পলিথিন বা পলিপ্রোপাইলিন শপিং ব্যাগের বিকল্প পণ্য মেলা এবং বিকল্প পণ্যসামগ্রী বিষয়ক সেমিনারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আগামী ১ অক্টোবর (কাল) থেকে পলিথিন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীরা তদারকি করবে। স্কুলের তালিকা হয়েছে। আজকে শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন হবে।

উপদেষ্টা আরো বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে সচিবালয়কে ওয়ানটাইম প্লাস্টিক মুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সুদিন ফিরিয়ে আনতে পাট শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার লক্ষ্যে মোহাম্মদপুরে ক্লিন-আপ কার্যক্রম উদ্বোধন ও বিকল্পসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে সুপারশপগুলোতে এবং কাঁচাবাজার ও পলিথিন উৎপাদন কারখানায় পহেলা নভেম্বর থেকে অভিযান শুরু হবে। অভিযানের মাধ্যমেই পলিথিনবিরোধী কার্যক্রম শুরু হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সতর্ক করার এবং কঠোর হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। তবে অভিযানের মূল লক্ষ্য শাস্তি না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেই তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি, পলিথিন ব্যবহার বন্ধে অভিযানই করতে হবে না। আন্তর্জাতিকভাবেই পলিথিনের ক্ষতির মাত্রা প্রমাণিত। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজ ব্যবহার করা যেতে পারে।

জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় তিন হাজার কারখানায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন উৎপাদিত হচ্ছে। পলিথিনের অর্থনীতি বিশাল। সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ ও মোড়ক সামগ্রীর ওপর পাঁচ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ন্যাচার কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (বিএনসিএ)।

পলিথিন আসলে পচে না। শত শত বছর মাটির নিচে অক্ষত থেকে যায়। ২০০ থেকে ৪০০ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। নিষিদ্ধ এই পলিথিন একই সঙ্গে কৃষিজমি ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, পলিথিন বা প্লাস্টিকের সমগোত্রীয় মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন লবণ, চিনি, মাছের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার খোলামেলাভাবেই বেড়েছে, যা খুবই উদ্বেগজনক ও হতাশার। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর আইন থাকার পরও নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রি বন্ধ করা যাচ্ছে না। ক্রেতারাও পলিথিনে মালামাল গ্রহণ করছেন। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে যে পরিমাণ চাপ বা কড়াকড়ি প্রয়োজন, তা আসলে নেই।

দেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন আছে। তবু দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশের প্লাস্টিক ও পলিথিন মূলত মাটি ও নদীতে গিয়ে জমা হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এখানে কী পরিমাণে প্লাস্টিক জমা হয়েছে, তা চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে। নয়তো এ দেশের মাটি ও পানি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। এখানে ফসল ফলানো ও মাছ চাষ কঠিন হয়ে যাবে। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহারের ধরন নিয়ে গবেষণায় বিস্তারিত উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার কারখানায় প্লাস্টিক ও পলিথিন তৈরি হয়। এসব কারখানায় দিনে ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হয়। বেশিরভাগ কারখানা মাঝারি ও ছোট আকারের। অধিকাংশ কারখানা ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এসব কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনা দুর্বল। ফলে দূষণ তৈরি করে বেশি। প্লাস্টিক দূষণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ।

গবেষণায় বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর বর্জ্য পরে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। এতে সাগরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। শুধু ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে জরিপ চালিয়ে ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া গেছে। ওই বর্জ্য গত কয়েক যুগে জমা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত