ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিজেদের পছন্দের সরকারকে হটিয়ে তার দায়িত্ব গ্রহণকে শুরু থেকেই ভালো চোখে দেখেনি ভারত। এজন্য প্রায় দুই মাস কেটে গেলেও এখনো এই সরকারের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক সম্পর্কে’ ফিরেনি ভারত। এর মধ্যেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো যোগ দিয়ে বাজিমাত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।
সব রীতি ভেঙে জাতিসংঘ অধিবেশন চলাকালে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেই বৈঠকে তিনি যে হৃদ্যতা দেখিয়েছেন সেটাও বিরল। জানিয়েছেন সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকবে। এছাড়াও জাতিসংঘ মহাসচিবসহ প্রভাবশালী দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা ড. ইউনূসকে যেভাবে বরণ করে নিয়েছেন, সেটা নজিরবিহীন। ড. ইউনূসের এই সফরকে অনেকেই ‘জাতিসংঘ জয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
তবে ড. ইউনূসের সরকারকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা ভারতের জন্য তার ‘জাতিসংঘ জয়’ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ইউনূসের সরকারকে বরণ করে নিয়েছে, তাতে এই সরকারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নয়াদিল্লির নতুন মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারের খবরে ভারতের এই দুশ্চিন্তার কথা জানানো হয়েছে। গতকাল বুধবার ‘রাষ্ট্রপুঞ্জে ইউনূসের সফল দৌত্যে চিন্তায় নয়াদিল্লি’ শিরোনামে খবরে আনন্দবাজার লিখেছে- ‘বাংলাদেশের মাটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন রুখতে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে ক্ষোভ বাড়ছে সাউথ ব্লকে।
সে কারণে মুহাম্মদ ইউনূস চাইলেও রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে তার সঙ্গে বৈঠক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এড়িয়ে গিয়েছিলেন বলে সূত্রের খবর। তবে মোদির সঙ্গে বৈঠক না হলেও আমেরিকার সিলমোহর নিয়ে সফলভাবেই আন্তর্জাতিক দৌত্য সারলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। যা দিল্লির আশঙ্কা বাড়িয়েছে।’
আনন্দবাজার লিখেছে- ‘সাধারণ সম্মেলনে নিজে বক্তৃতা দেয়ার পাশাপাশি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন, বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইউনূস। পাশাপাশি, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, বিশ্বব্যাংকের প্রধান এবং এডিবির শীর্ষকর্তার সঙ্গেও আলাদা করে আলোচনা হয়েছে তার। এসব আলোচনার মূল সূর একটাই। শেখ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের সরকারি নেতৃত্বের প্রতি পশ্চিমি দুনিয়া এবং আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতা থাকবে ভবিষ্যতে। যে সহায়তার কৌশলগত, বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। এক কথায়, ভারতের প্রতি দ্বিপাক্ষিক নির্ভরতার জায়গা সঙ্কুচিত করাই এই মুহূর্তে ইউনূস সরকারের লক্ষ্য কি না, সেই প্রশ্নও উঠে আসছে কূটনৈতিক মহলে।’ পত্রিকাটির খবরে বলা হয়- ‘সাউথ ব্লকের চিন্তা বাড়িয়ে নিউ ইয়র্কে ইউনূসের দৌত্য তালিকা প্রসারিত হয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গেও।
সূত্রের খবর, সার্ককে জাগিয়ে তোলা ও বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করা নিয়ে কথা হয় ইউনূস-শরিফের। কূটনৈতিক মহলের বক্তব্য, বিদেশ মন্ত্রক গত ১০০ দিনে কাজকর্মের খতিয়ানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ না রাখলেও এই মুহূর্তে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের কৌশল রচনাই মোদি সরকারকে অগ্রাধিকারের মধ্যে রাখতে হবে।’
আনন্দবাজার লিখেছে- ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বার্তা থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশ এখন তার নীতির কেন্দ্রে জামায়াতে ইসলামীকে আরো বেশি করে রাখতে চাইছে। যা স্বস্তির নয় নয়াদিল্লির কাছে। আপাতত দুটি বিষয় স্পষ্ট। এক, এই অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে গিয়েছে সে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে। দুই, ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক আগামী দিনে এগোলে তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো কূটনৈতিক অস্ত্র এখনো ভারতের হাতে নেই। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন ইউনূস। এই বার্তাই তিনি দিতে চেয়েছেন, ক্ষমতার বদল হলেও তাকে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা ঠিক নয়। বাংলাদেশের জাতিসত্তার স্বকীয়তাতেই তিনি বিশ্বাসী।’