ইসরায়েল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিণতি হবে গুরুতর। তবে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হলে তা একটি বড় আঞ্চলিক সংঘাতের রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গাজার ওপর ইসরায়েলের লাগাতার হামলা, লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা ও ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণের পরে কিছুটা নিরবতা দেখিয়েছিল তেহরান। তবে মঙ্গলবার তারা ইসরায়েলের ওপর পাল্টা আঘাত হেনে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবের দিকে নিক্ষেপ করেছে। এই হামলায় ইসরায়েলের কোনো নাগরিক নিহত না হলেও সামরিক অবস্থানগুলোতে বড় ধরনের আঘাত হানা হয়। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলি নাগরিকদের বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটতে দেখা গেছে। যা বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে বড় চমক ছিল যে, ইসরায়েলের বিখ্যাত ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সব ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে আকাশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের দৃশ্য অনেকের জন্যই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পরামর্শ দিয়েছেন এই পরিস্থিতিকে ‘জয়’ হিসেবে গণ্য করার। তবে ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি জানিয়েছেন, এই হামলার জন্য ‘পরিণতি’ বয়ে আনবে এবং ইসরায়েল নিজের পছন্দের সময়ে ও স্থানে পাল্টা আঘাত হানবে। তার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে ইসরায়েল আঘাতের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা অনেকাংশেই ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করছে। ইরান স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ইসরায়েল যদি আর কোনও আক্রমণ চালায়, তবে তার পাল্টা জবাব আসবে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক রামি খুরি ট্রিটি ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না যে ইরান একটি বৃহত্তর হামলার পরিকল্পনা করেছে কিনা। তবে ইরানের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে এটি মনে হচ্ছে না। ইরানের জাতিসংঘ মিশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই হামলা লেবাননে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে করা হয়েছে। তারা এটিকে ‘আইনি, যৌক্তিক ও বৈধ প্রতিক্রিয়া’ বলে বর্ণনা করেছে। মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির অধ্যাপক মাহজুব জুয়েইরি বলেন, ইরানের এই আঘাত মূলত নেতানিয়াহুর সরকারের সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ‘রাজনৈতিক ও সামরিক হয়রানি’র জবাব। তবে ইসরায়েল এ ঘটনার প্রভাব পর্যালোচনা করতে কিছুটা সময় নেবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, এই যুদ্ধ থামানোর কোনও জোর পরিকল্পনা নেই। আমি স্থিতিশীলতার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।
আঞ্চলিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ইসরায়েল ও ইরান উভয়ই নিজেদের রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক টিকে থাকার বিষয়টি এই যুদ্ধে গভীরভাবে যুক্ত, একইভাবে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা টিকিয়ে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই উভয় পক্ষই তাদের অবস্থান বজায় রাখবে, যতক্ষণ না কোনো পক্ষ সম্পূর্ণ পরাজিত হয় অথবা একটি শক্তিশালী পক্ষ উভয়কে এই যুদ্ধে ইতি টানতে রাজি করতে পারে।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি না, প্রশ্নের জবাবে জুয়েইরি বলেন, লেবানন ও ইয়েমেন এরই মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা বলছেন, লেবাননে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ আহত ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদিকে ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে স্থল অভিযানে নেমেছে, যা হিজবুল্লাহর অবস্থান লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এই উত্তেজনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং এটি অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। আমাদের অবিলম্বে একটি অস্ত্র বিরতি প্রয়োজন। ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাত শুরু হয় গাজায় হামলার জবাবে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে তাদের হামলা বাড়িয়েছিল। গাজায় এক বছরের সংঘাতে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের আঘাতে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কয়েকজন শীর্ষ নেতা সিরিয়ার দামেস্কে নিহত হন। এর জবাবে ইরান ইসরায়েলের ওপর ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, তবে প্রায় সবই আয়রন ডোম দ্বারা প্রতিহত করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত নতুন করে আরো বিস্তৃত হতে পারে। তেমনটি হলে পুরো অঞ্চলকে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে নিমজ্জিত করার শঙ্কা রয়েছে। সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড