আগামী বছরে সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাধ্য হয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালালে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপরেই জাতীয় সংসদ নিবাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন দ্রুত অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করাটা সম্ভব হতে পারে। তবে এতে অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে বলে তিনি মনে করেন। এটি তার প্রাথমিক অনুমান বলেও জানান তিনি।

আইন উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের জন্য অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য সার্চ কমিটি লাগবে। সার্চ কমিটি করতে হলে পিএসসির চেয়ারম্যান লাগবে। সেটার নিয়োগ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। সঠিক ভোটার তালিকা করতে হবে। নির্বাচনের জন্য এসব ধাপ চিন্তা করতে হবে। নিশ্চয় কেউ চায়নি হাবিবুল আউয়াল কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেবে। এটা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। ফ্যাসিস্ট সরকার ২০২৪ সালের ভুয়া নির্বাচনের ভোটার তালিকা নিয়ে ব্যাপক অরাজকতা করেছিল। হয়তো ভয় ছিল, নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে কী অবস্থা হবে। সুতরাং ভোটের আগে একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ছাড়া এই ভোটার তালিকা তৈরির আদেশ কেউ দিতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টার আদেশে ভোটার তালিকা হবে না। নির্বাচন কমিশনের আদেশে হবে।

এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর জাপানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনএইচকের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয়ার ফাঁকে তিনি এ সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারে মূল লক্ষ্য সংস্কারকাজ ও যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য। তাদের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার উদ্দেশ্য নেই। ড. ইউনূস বলেন, আমরা এখানে দীর্ঘদিন থাকতে আসিনি। আমাদের কাজ যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেয়া। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো দেশ সংস্কার ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা। আমরা যত দ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়ন করব। অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহর স্মরণসভায় গাজীপুরের কাপাসিয়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, যত দ্রুত নির্বাচন করা যাবে, ততই দেশের মঙ্গল হবে। অতিদ্রুত সংস্কার করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে আবারও রাজপথে আন্দোলন করবো। মির্জা ফখরুল বলেন, কোনো রকম তালবাহানা সহ্য করা হবে না। সব মামলা প্রত্যাহার করে অবিলম্বে তারেক রহমানকে দেশে ফেরার সুযোগ দিতে হবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা না হলে কখনও নিরপেক্ষ অবস্থা তৈরি হবে না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, হাসিনা পালালেও সংকট কাটেনি। মানুষ বিশ্বাস করে, অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ এখনও নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে। চক্রান্ত করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে।

গত বুধবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনেক দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। অনেকে দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে আসছে। তিনি বলেন, দাবি পূরণ করার জন্য উপদেষ্টা সরকার নয়, প্রয়োজন জনগণের নির্বাচিত সরকার। জামায়াতের নায়েবে আমির আরো বলেন, অতীতে দেখা গেছে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ক্ষমতা আর ছাড়তে চায় না। আবার অতীতে কেউ কেউ ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে নতুন নতুন দল গঠন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার চেষ্টাও করেছে। রাষ্ট্র সংস্কার করে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দেয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর গত ১১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই ভাষণে বিচার বিভাগ, ব্যাংক খাত, প্রশাসনসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারসহ নিজেদের কর্ম পরিকল্পনার ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। সেই মোতাবেক এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন। তবে এখনো শৃঙ্খলা আসেনি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে। গত ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিনিময় সভা হয়। সেই সভায় দলগুলো দাবি জানায়, প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং স্বৈরাচার ও দুঃশাসন প্রতিরোধে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ সব রাষ্ট্রীয় অঙ্গকে ঢেলে সাজাতে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন নেতারা। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও বিভিন্ন দাবির বিষয়ে পৃথকভাবে লিখিত প্রস্তাব পেশ করে। দলগুলোর শীর্ষ নেতারাও তাদের আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানান।

দলগুলো হচ্ছে- খেলাফত মজলিস, নিজামে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমন্বয় জোট, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাসদ, গণফোরাম, জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারাও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেন।

এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ বলেছিলেন, তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ বা পূর্বাভাস দেয়া। এই রোডম্যাপ ৬ মাস বা ৯ মাস পর্যন্ত হতে পারে। প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত বলে আমরা জোর দিয়েছি। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে ততই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দল এবং দেশের জন্য মঙ্গল। শান্তি, সুশাসন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করার আগে নির্বাচন পরিচালনা করা উচিত নয়। তিনি বলেন, আগে সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। দেশের মানুষের মধ্যে মানবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

ছয়টি ইসলামিক দলের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হক বলেন, আমাদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা তাকে (ইউনূস) বলেছি যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করতে এবং নির্বাচন আয়োজনে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব এড়াতে।

প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর তারা অনতিবিলম্বে নির্বাচন আয়োজন করবেন। প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজি করানো হয়। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। শপথ নেয়ার পর দুই মাসের বেশি সময় পার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে ছয়টি সংস্কার কমিশন। প্রজ্ঞাপন জারির পর কাজও শুরু করেছেন এসব কমিশনের প্রধানরা। তবে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে।