তত্ত্বাবধায়ক সরকারই চায় বিএনপি

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে নজিরবিহীন কারচুপির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতির কাঁধে ফ্যাসিবাদ ঝেঁকে বসে। যার প্রতিবাদে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল। সবশেষ গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করে দলটি। সেই আন্দোলনও প্রতিহত করে আওয়ামী সরকার আবারো ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীতে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতন হয়। পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর থেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো।

বিএনপির নেতারা বলছেন, আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছি। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার দেশে একনায়কতন্ত্র চালু করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের অধীনে নির্বাচন করে জোর করে ক্ষমতায় টিকেছিল। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। এবার আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাই। কারণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটিই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির রাজনৈতিক অঙ্গীকার। আমাদের ৩১ দফা প্রতিশ্রুতির মধ্যে বলা আছে দল ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে। এখন যেহেতু সুযোগ তৈরি হয়েছে, আবেদনের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল একটি কার্যকর ব্যবস্থা। যা সব মহলে গ্রহণযোগ্য ছিল। আমরা সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আইনিভাবে চেষ্টা করছি। তিনি আরো বলেন, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এখনো বিএনপি চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক।

এদিকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়েছে বিএনপি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞও তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল করে আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন করেছেন। বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তাদের অন্যতম রাজনৈতিক অঙ্গীকার। অন্যায়ভাবে তা বাতিল করা হয়। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে অনেক ত্রুটি ছিল। রায়ে দুই ধরনের বক্তব্য ছিল, যা পরস্পরবিরোধী। এ রায় বাতিলের যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করেন তারা।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে বিএনপি। এর দুই বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। পরে ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে সেই রিট খারিজ হলে এ ব্যবস্থা বহালই থাকে। পরের বছর এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়।

এরপরে ২০০৭ সালে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালে আপিল শুনানি শুরু হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকসহ সাত বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। পরের বছর সেপ্টেম্বরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়েছিল, জাতীয় সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচন (দশম ও এগারতম) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। কিন্তু তা আর হয়নি। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আগস্টে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে একটি রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন। বাকি চারজন হলেন তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। তাদের পক্ষে ওই রিট আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে। এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একই আর্জি জানিয়ে আরেকটি আবেদন করেন। বিএনপি মহাসচিবের পক্ষে বুধবার সুপ্রিমকোর্টে রিভিউ আবেদন করা হয়।

৮০৭ পৃষ্ঠার ওই রিভিউ আবেদন আজ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, রিভিউ আবেদনে ১০টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-আদালতে প্রকাশ্যে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশ সংবিধান সংশোধনের পর পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে বাদ দেয়া এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অবসরের ১৮ মাস পর রায় প্রকাশ করা একটি বিচার বিভাগীয় প্রতারণা; বিষয়টি নিয়ে একটি ফৌজদারি মামলাও চলমান; তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ ধ্বংস করা হয়েছে; একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এদিকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য আগামী ২৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন চেম্বার আদালত। গতকাল রোববার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক শুনানির জন্য এদিন ধার্য করেন। আদালতে রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ড. শরীফ ভুঁইয়া। এর আগে গত ১৬ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এদিকে গত আগস্ট মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার পৃথক রিভিউ আবেদন দায়ের করেছেন।

২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। তবে পরবর্তী ১০ম ও ১১তম নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আদালত। রায়ে বলা হয় এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে সংসদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।

আদালত তার রায়ে বলেন, আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই আবেদনটি গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬ এই নির্দেশের পর থেকে অবৈধ ও সংবিধান বহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। তবে আইনসম্মত না হলেও (প্রয়োজনের কারণে আইনসম্মত এবং জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, সুপ্রাচীনকাল ধরে চলে আসা নীতিমালার ভিত্তিতে) দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায়ই হতে পারে।

এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে অথবা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে একজনকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বিধানটি বাতিল করার পূর্ণ স্বাধীনতাও সংসদের থাকবে। একইসঙ্গে ২০০৫ সালে এ প্রসঙ্গে দায়ের করা লিভ টু আপিলটিও খারিজ করা হলো।

সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালে। এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন।