ইরান, ইসরায়েল, লেবানন ও গাজায় পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনী নির্বিচারে গাজা, লেবানের নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। বহুতল আবাসিক ভবন এবং হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়ে ধ?ংসস্তূপে পরিণত করেছে। এবার সেই ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। মধ্যপাচ্যের বিভিন? দেশে বছরে বছরে ইসরায়েলি বাহিনী আগ্রাসন চালালেও নিশ্চুপ আছে পশ্চিমা রাষ্ট্র।
সর্বশেষ গত শনিবার দিবাগত রাতে ইরানের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়েছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন? গণমাধ্যম প্রতিবেদন করেছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সামরিক শক্তিশালী দেশ ইরানে শনিবার ভোরে হামলা চালিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। এই হামলার জবাবে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালাতে পারে তেহরান। গতকাল শনিবার সূর্যের আলো ফোটার আগে রাজধানী তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান সেখানকার বাসিন্দারা। বিশেষ করে রাজধানীর পশ্চিমদিকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আধা সরকারি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর হামলা প্রতিরোধে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহারের শব্দ এগুলো। গত ১ অক্টোবর দখলদার ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ১৮১টি ব্যালাস্টিক মিসাইল ছোড়ে ইরান। সাবেক হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ এবং চৌকস বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডার আব?াস নিলফোরোসানকে হত্যার জবাব দিতে এসব মিসাইল ছোড়ে তেহরান। এতে লক্ষ্য করা হয় দখলদার ইসরায়েলের বিমান ঘাঁটি। ইসরায়েলকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় ওই ভূখণ্ডকে অধিকৃত ফিলিস্তিনের অংশ হিসেবে অভিহিত করে থাকে ইরান। তেহরানের পক্ষ থেকে ওই সময় জানানো হয়- ইসরায়েল যদি ইরানে কোনো ধরনের হামলা চালায় তাহলে উপযুক্ত জবাব দেবে তেহরান। ইসরায়েল হামলা চালানোয় ইরান এখন কী ব্যবস্থা নেবে সেটির দিকে নজর রাখছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমাদেশগুলো ইরানের প্রতি আহ?ান জানিয়েছে হামলা পাল্টা-হামলার সাইকেল যেন এখনই শেষ করা হয়।
ইরানে হামলা করে ইসরায়েল। দেশটির ইলাম, খুজেস্তান ও তেহরান প্রদেশের কয়েকটি সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়। ইসরাইল জানিয়েছে, ইরান ও এর মিত্রদের হামলার প্রতিবাদে এ হামলা চালানো হয়। ইরান বলছে, ইসরায়েলের এ হামলায় দেশটির দুজন সেনার মৃত্যু হয়েছে। দেশটির গণমাধ্যম ইরনা নিউজের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইসরায়েলের এ হামলার সমালোচনা করেছে সৌদি আরব, ওমান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, ইয়েমেন ও কাতার। এছাড়াও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।
ইরানের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের ২ সেনা নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে উদ্ধৃত করে ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, ইরানের নিরাপত্তা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ইহুদিবাদী ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় তাদের ২ সেনা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। ইরান জানিয়েছে, তাদের সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তাদের পাল্টা বিমান হামলায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা এবং অন্যান্য ব্যবস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে ইসরায়েল ইরানকে সতর্ক করে বলেছে যে তারা পাল্টা হামলা চালালে তেহরানকে চড়ামূল্য দিতে হবে।
সৌদি আরব ইরানের ওপর ইসরায়েলের সামরিক হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে একে ‘ইরানের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’ ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। এক বিবৃতিতে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এটি ইরানের আঞ্চলিক অখণ্ডতার মারাত্মক লঙ্ঘন এবং প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আইনের বিরোধী।
এর আগে, গত ১ অক্টোবর হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ এবং আইআরজিসি (ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস) জেনারেল আব?াস নিলফোরোশানের হত্যার জবাবে ইসরায়েলের সামরিক এবং গোয়েন্দা ঘাঁটিতে প্রায় ২০০টি ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। এ হামলার পর ইরানি কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ইসরায়েল কোনো পদক্ষেপ নিলে ইরান আরো কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
গত শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হাসবিয়াতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে তিনজন গণমাধ্যমকর্মী নিহত হন। হামলার সময় নিজেদের বাসস্থানে ঘুমাচ্ছিলেন এসব গণমাধ্যমকর্মী। হাসবিয়া শহরের ওই আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা হয়। এতে দুই ক্যামেরা পারসন এবং এক প্রকৌশলী নিহত হন। হাসবিয়া থেকে আল জাজিরার প্রতিনিধি ইমরান খান বলেন, এটা অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা। ইসরায়েল কোনো সতর্কসংকেত দেয়নি। হাসবিয়া এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়ার মতো কোনো নির্দেশনা ছিল না। এলাকাটি তুলনামূলক শান্ত ছিল। নিহত ব্যক্তিরা হলেন ক্যামেরাপারসন ঘাসান নাজ্জার, প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেদা ও ক্যামেরাপারসন উইসাম কাসিম। তাদের মধ্যে নাজ্জার ও রেদা আল মায়াদিন টিভি চ্যানেলে কাজ করতেন। আর হিজবুল্লাহ সংশ্লিষ্ট আল মানার টিভি বলেছে, উইসাম কাসিম তাদের ক্যামেরাপারসন। ঘটনাস্থলে থাকা প্রতিবেদকরা বলেছেন, ওই ব্যক্তিরা যে বাংলোটিতে ঘুমাচ্ছিলেন সেটিকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করছে ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের সশস্ত্র হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের সেনাদের মধ্যে সম্মুখ লড়াই চলছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে এক বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়ছে হিজবুল্লাহ ও হুতি। তাদের সমরাস্ত্র ও আর্থিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে ইরান। পাশাপাশি গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসকেও সহযোগিতা করে আসছিল তেহরান। ইরান সরাসরি জড়িত না থাকলেও ইসরায়েলের সঙ্গে চলছিল ছায়াযুদ্ধ। তবে এবার ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিবাদে সরাসরি যুদ্ধে ইরান জড়াতে পারে।
ইরান ও ইসরায়েলকে সংযত হওয়ার আহ?ান জানিয়ে বিশ্বনেতারা বলছেন, এই সংঘাত এখনই বন্ধ না করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যের পুরো অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। তবে বরাবরের মতোই ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সেনাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছে ওয়াশিংটন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দেবে। তবে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা সমর্থন করে না যুক্তরাষ্ট্র-এ কথাও বলেছেন তিনি। প্রসঙ্গত, ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্য। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ইরানের হামলার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।