ঢাকা ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আগের তুলনায় বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আগের তুলনায় বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে

ভয়েস অব আমেরিকার এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। জরিপের ফলাফলে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।

অক্টোবর মাসের শেষের দিকে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৬৪.১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তুলনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে।

মাত্র ১৫.৩ শতাংশ মনে করেন বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য আগের চেয়ে খারাপ নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং ১৭.৯ শতাংশ মনে করেন পরিস্থিতি আগের মতই আছে।

জরিপে ১০০০ উত্তরদাতাকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের তুলনা করতে বলা হয়।

বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের ১০০০ উত্তরদাতা বাছাই করা হয়। সেখানে সমান সংখ্যার নারী এবং পুরুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ৯২.৭ শতাংশ ছিল মুসলিম। উত্তরদাতাদের অর্ধেকের একটু বেশি ছিল ৩৪ বছর বয়সের নিচে এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহুরে মানুষ।

পরিস্থিতির অবনতির পর উন্নতি : বাংলাদেশ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রতিশোধ প্রবণতা দেখা যায়, তার বড় এক ধাক্কা গিয়ে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে সনাতনী ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের ওপর। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলছেন, আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সম্পৃক্তরা কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, আবার শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যে বরাবরই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, সেদিকে ইঙ্গিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচণ্ডএর দক্ষিণ এশিয়া পরিচাল মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, কোনো সরকার তাদের অধিকার রক্ষার জন্য খুব একটা কিছু করে না। ভয়েস আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী গোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃতভাবে আলাদা করে রাখা হয়েছে এবং সামরিক বাহিনী আর কর্তৃপক্ষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। হিন্দু এবং আহমদিয়া সম্প্রদায় উগ্রবাদী সংগঠনের আক্রমণের মুখে পড়ে।

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রশাসন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল পাহারা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া জন্য।

মানবাধিকার কর্মী নুর খান বলেন, বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণ মানুষের তরফ থেকে, রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর তরফ থেকে। এর ফলে দেখা গেছে, পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য : তবে জরিপে ফলাফলে, নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের কিছুটা তফাৎ লক্ষ্য করা গেছে। মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৩.৯ শতাংশ মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের ৩৩.৯ শতাংশ মনে করেন তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ করছে। ঢাকার বাসিন্দা জয়তী সরকার আগে কখনো তার বা পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত নন। তিনি বলছেন, আগের সরকারের সময় আমি আমার মেয়েকে নিয়ে রাত ১১টায় ধানমন্ডিতে আমাদের বাড়িতে ফিরেছি, কিছু মনে হতো না। কিন্তু এখন রাত আটটার দিকে মেয়েকে নিয়ে ফিরি, তখন আমার ভয় করে। আমি ২০ বছর ধরে ঢাকা শহরে আছি; কিন্তু আগে এরকম ভয়ের মধ্যে থাকিনি কখনো। সংখ্যালঘুদের স্বস্তির জায়গা : ভয়েস অফ আমেরিকার জরিপে দেখা গেছে মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৬.১ শতাংশ মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৯.৫ শতাংশ এই ধারণার সঙ্গে একমত। অর্থাৎ, সংখ্যালঘুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে আগের তুলনায় তারা বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে। জয়তী সরকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও, তিনিও একটি স্বস্তির জায়গা দেখতে পাচ্ছেন।

তার ভাষ্য, আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল, তাদের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় লোকজন হিন্দুদের জমি অল্প দামে কিনেছে বা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। এরা এখন আর নাই। তাই একটা স্বস্তি বিরাজ করছে।

ঢাকার বাসিন্দা এবং বেসরকারি সংস্থায় প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত হীরেন পণ্ডিত মনে করছেন, সম্প্রতি গ্রামে-গঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে তিনিও শঙ্কার মধ্যেই আছেন।

ভাষ্য, আমাদের গ্রামের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো আমরা নিরপত্তা নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে থাকি। একটা নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই।

আন্তর্জাতিক উদ্বেগ : বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত তার সরকারের উদ্বেগের কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানান। তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ অভিহিত করে বলেছে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খবর ‘অতিরঞ্জিত’ করে প্রচার করা হচ্ছে। সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ১৭ অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হন, কিন্তু সেগুলো ছিল রাজনৈতিক। তিনি বলেছেন, অল্প যে সমস্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গাঙ্গুলি বলছেন, শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনের প্রতি ভারতের সমর্থনও হিন্দুদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এবং আগামীতে দিল্লির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।

তার মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে চিন্তিত হওয়া। কিন্তু যেসব গোষ্ঠী ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে ঘৃণা এবং সহিংসতা ছড়াতে চায়, তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে ভারতের আরও সাবধান হওয়া উচিত। নুর খানের মতে, একটা আশঙ্কা অনেক মানুষের মধ্যেই আছে যে, আগামী তিন মাস পর চিত্র কী হবে। অর্থাৎ, আস্থার সংকট রয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে জনসমক্ষে আশ্বস্ত করতে সরকার এবং ছাত্র নেতাদের আরো পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত