রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ
‘জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে’ সবাইকে এক হওয়ার আহ্বান
* জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি বিএনপির * তিন বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা : ফুয়াদ * ষড়যন্ত্রকারীরা বিজয়ের অভ্যুত্থান মুছে দিতে চায়
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার প্রস্তাবের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে ফ্যাসিবাদ কায়েমকারীরা দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্র করছেন। এতে দেশের চলমান পরিস্থিতি এবং ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি হাইকমিশনে হামলা, জাতীয় পতাকা ছেঁড়ার ঘটনায় দু’দেশে উত্তেজনার পারদ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে ধাপে ধাপে সংলাপ করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত মঙ্গলবার ছাত্র নেতাদের সঙ্গে সংলাপ এবং গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সংলাপ শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটিকে মুছে দিয়ে আগের অবস্থায় ফেরানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই অপচেষ্টা বিদেশ থেকেও চলছে ইঙ্গিত দিয়ে ড. ইউনূস ‘জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে’ রাজনৈতিক মতাদর্শ পাশে রেখে সবাইকে একজোট হওয়ার আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তা হয়তো অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। নানাভাবে এটাকে রুখে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। গত ৫ আগস্টের পর বাস্তবতার দিক থেকে আপনারা এগুলো দেখেছেন। আমরা নতুন যে বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে আরেক কাহিনী তারা রচনা করার চেষ্টা করছে। সারাক্ষণ একটা রূপরেখা তারা দিয়ে যাচ্ছে। এটা যে এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে তা নয়, বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যে এটা ছড়িয়ে গেছে। ড. ইউনূস বলেন, বিজয়ের অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি তারা এটা মুছে দিতে চায়। আড়াল করতে চায়। এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়। তাদের মতে, ‘আমাদের এখানে ভয়ংকর একটা কাণ্ড ঘটে গিয়েছে, এটা থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে’। তাদের এই অবস্থান মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য এবং বাস্তবকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সবাইকে এক জোট হতে হবে। কারণ এখানে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের বিষয় নয়, জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমরা যে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, সেটাকে তারা মুছে দিতে চায়। তারা আগের ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না। কিন্তু ভঙ্গি হলো যে, আগেরটা ভালো ছিল। এর আগেরটা কীভাবে তারা নিয়ে আসবে, সেই চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের শক্তি এত বেশি, অর্থের শক্তি, আয়োজনের শক্তি, মানুষকে প্রলুব্ধ করতে পারছে। যে কল্পকাহিনী তারা তৈরি করছে, সেটাতে অনেকে সংশয়ে পড়ছে।
গতকাল রাতে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে সরকারের জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে সার্বিক সংস্কারের পর রোডম্যাপ ঘোষণা করে দ্রুত নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেয়া এই নেতা বলেন, অতীতে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে সবাই মিলে যেভাবে পরাজিত করেছে এখন তাদের এবং দোসরদের রুখে দিতে সবাই একত্রে কাজ করার কথা বলেছি। প্রধান উপদেষ্টা ঐক্যের ডাক দেবেন। আমরা সরকারের পাশে থাকার কথা বলেছি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচনের কথাও বলেছি। আমরা বলেছি, এই সরকার জনগণের ভোটের ব্যবস্থা করতে ওয়াদাবদ্ধ। তাই সংস্কারের পর রোডম্যাপ ঘোষণা করে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথা বলেছি। জনগণ নির্বাচনের রোডম্যাপ পেলে নির্বাচনমুখী হবে। তখন যেসব ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছেন এসব আর কেউ করতে সাহস পাবে না।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমি থেকে বের হয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) যুগ্ম সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ সাংবাদিকদের বলেন, দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিন বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এসময় বৈঠকের এজেন্ডা সরকারের পক্ষে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান তুলে ধরেন বলেও জানান তিনি।
আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করছেন প্রধান উপদেষ্টা। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- ভারতসহ সারা বিশ্বে যে প্রোপাগান্ডা চলছে সেগুলোর বিষয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয়, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন অফিস ভাঙচুর ও পতাকা অপমান করা নিয়ে করণীয় এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে গল্প ও উপন্যাস সারা দুনিয়ায় চলছে তা নিয়ে মতামত।
এদিন বৈঠকে নির্বাচন বিষয়ে কোনো আলোচনা রাখা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, সব দল তাদের মতামত তুলে ধরছে, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয় কী। আলোচ্যসূচিতে নির্বাচন না থাকলেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেয়ার জন্য তাগাদা দেয় কয়েকটি রাজনৈতিক দল। স্বরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কিছু মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে অনেকে সেবার একটা ঘাটতি বোধ করছেন, এক্ষেত্রে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে। সবাই রাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করেছেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমরা আপনাদের পেছনে আছি। আপনাদের সিদ্ধান্ত ও লড়াইয়ের পেছনে আমরা অংশীদার।
এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব বলেন, বৈঠকে একজন সাবেক মিলিটারি অফিসার, যিনি একটি দলেরও প্রধান, তিনি ভারতের সঙ্গে উসকানি ও উদ্বেগের জায়গা থেকে কীভাবে ভারসাম্যের জায়গায় নিয়ে আসা যায় তার জন্য কাজের পরামর্শ দেন। দুয়েকজন পরামর্শ দিয়েছেন সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে একটি জাতীয় কমিশন করা যায় কি না। জাতীয় কমিশন করলে ৫০ বছরের বঞ্চনা, বিশেষ করে গত ১৬ বছরে যে বঞ্চনা হয়েছে তার সত্যতা কতটুকু, তা বের হয়ে আসবে- এমন মতামতও কেউ কেউ দিয়েছেন বলে জানান ফুয়াদ। তিনি বলেন, কিছু মতামত এসেছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রে যেসব অ্যাম্বাসি আছে, সেখানে যারা কর্মরত তারা এখনো ফ্যাসিবাদী আমলের। তাই ওইসব রাষ্ট্রে বাংলাদেশ-বিদ্বেষ ঠেকানোর জন্য যা যা করা দরকার তা করছে না। সেক্ষেত্রে দূতাবাসগুলো থেকে তাদের বের করে এনে অভ্যুত্থানের পক্ষের অফিসারদের নিয়োগ করা দরকার। একইসঙ্গে চলমান প্রপাগাণ্ডা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রের পিআর সেল করা দরকার বলে কিছু রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে বলেও জানান এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব।
সংলাপ অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন অংশ নেন। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে অংশ নেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম। এছাড়াও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জেনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের নূরুল হক নূর ও রাশেদ খান, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জু ও আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদের রফিকুল ইসলাম বাবলু, বাংলাদেশ খেলাফত মসলিসের মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের আবদুল বাসিত আজাদ ও জাহাঙ্গীর হোসেন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, এনপিপি ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ প্রমুখ বৈঠকে অংশ নেন।
এর আগে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গত মঙ্গলবার যমুনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। আজকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
