ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি

দুর্যোগ মোকাবিলায়  বাংলাদেশের প্রস্তুতি

বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খড়া ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা হিসেবে প্রত্যেক বছরে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। এসব ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ভারতের উজানের পানিতে দক্ষিণাঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় মানুষের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা দিয়েছে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দুর্যোগব্যবস্থাপনা মোকাবিলায় যেসব দুর্বলতা দিক রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুতই সমাধানের পথ খুঁজছে সংশ্লিষ্টরা। দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্যেক বছরে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়, কিন্তু এবার ভারতের উজানের পানিতে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ফেনী ও কুমিল্লাসহ ১১ জেলায় বন্যায় ১৪ হাজার ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ টাকা সমমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৯ লাখ ৪২ হাজার ৮২১ জন। মারা গেছেন ৭৪ জন, আহত হয়েছেন ৬৮ জন। ২৩ কোটি ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৭৪০ টাকার ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭১৮ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার ৬১০ টাকার ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। আগামীতে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক এর নেতৃত্বে নিয়মিত মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বৈঠকে আলোচনা করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। একইসঙ্গে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও কমিটি হবে। তারা পুরো পুনর্বাসন কর্মসূচি মনিটরিং করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশ অতি মাত্রায় দুর্যোগপ্রবণ। বাংলাদেশ মৌসুমি বায়ুর প্রভাব এলাকায় অবস্থিত। উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা আর উত্তর-পূর্বে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা আসামণ্ডমিজোরাম। গ্রীষ্মকালে হিমালয় ও আসামণ্ডমিজোরাম থেকে বয়ে আসে হিমালয়ের বরফ গলা পানি ও বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকার বৃষ্টিপাতের পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। কিন্তু খননের অভাবে তিনটি নদী বালুরস্তূপে পরিণত হয়েছে। এতে বন্যার পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। আর এপ্রিল-মে ও অক্টোবর-নভেম্বরে বঙ্গোপসাগর প্রতিনিয়ত নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। এর অনেকগুলো আবার ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। অনেক সময়প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও ঘূর্ণিঝড়ের সাথে মারাত্মক জলোচ্ছ্বাস উপকূল অঞ্চলে আঘাত হানে। এসব কারণে, প্রতিবছরই ঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ও খরায় দেশের কোনো না কোনো অঞ্চল আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ, যেখানে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, ভূমিকম্প এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের দুর্যোগব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং উদাহরণ থেকে শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগের সময় দক্ষতার সঙ্গে মানুষকে মোকাবিলা করতে হবে। সেজন্য স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, হ্যারিকেন, টর্নেডে, খরা, শৈতপ্রবাহ প্রভৃতি প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে ১৭৯৫ (জুন), ১৮২২ (মে), ১৮৭২ (অক্টোবর), ১৮৭৬ (অক্টোবর), ১৮৯৭ (অক্টোবর), ১৯৬০ (অক্টোবর), ১৯৬১ (মে), ১৯৬৩ (মে), ১৯৬৫ (মে), ১৯৭০ (নভেম্বর), ১৯৮৫ (মে), ১৯৯১ (এপ্রিল), এর ঘূর্ণিঝড়, হ্যারিকেন, জলোচ্ছ্বাস, ১৮৯৭ (অক্টোবর)-এর ভূমিকম্প, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০০ বন্যা, ১৯৫৭ ও ১৯৭৯ সালের খরা এবং ১৯৯৭/৯৮ (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) ও ২০০৩ সালের শৈতপ্রবাহ এবং ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে অতিবর্ষণজনিত পাহাড়ি ধস, ২০০৭ সিডর, ২০০৮ নার্গিস, ২০০৯ আইলা, ২০১৩ মহাসেন, ২০১৫ কোমেন, ২০১৬ রোয়ানো এবং ২০১৭ সালের ঘূর্ণিঝড় মোরা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ও স্মরণীয়। ক্ষয়ক্ষতির অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের উপকূলের অনেক নতুন নতুন উপকূলীয় এলাকা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত ৫ নভেম্বর ঢাকায় বিয়াম ফাউন্ডেশনের মাল্টিপারপাস হলে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘নগর দুর্যোগব্যবস্থাপনা : সমস্যা ও প্রতিকার’ শীর্ষক কর্মশালায় দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেছিলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভূমিকম্প মোকাবিলায় ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী অন্য দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আদলে কার্যকর মডেল সৃষ্টি এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবাইকে প্রস্তুত রাখা এখন সময়ের দাবি। ত্রাণ উপদেষ্টা বলেন, জীবন রক্ষার জন্য আমাদের প্রয়োজন শক্তিশালী প্রারম্ভিক সতর্ক ব্যবস্থা, উন্নত বিল্ডিং কোড এবং আরও ভালো নগর পরিকল্পনা। মানুষ সচেতন হলেই ঝুঁকি হ্রাস পাবে। তিনি আরও বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় আগামীতে নিজস্ব প্রযুক্তি ও দক্ষ বিশেষজ্ঞ তৈরি করা হবে। আগামীতে ভূমিকম্পে বড় ধরনের দুর্যোগ হলে তা মেকাবিলা করতে কী কী দুর্বলতা আছে তা চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশকে দুর্যোগের এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের পথে হাটছে। দুর্যোগের প্রভাব মোকাবিলায় ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনরুদ্ধার করার ব্যবস্থার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুর্যোগব্যবস্থাপনা জনগণের জীবন, সম্পদ এবং পরিবেশকে দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে। উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড রিস্ক রিপোর্ট-২০১১ অনুযায়ী, দুর্যোগের ঝুঁকি ও বিপদাপন্নতার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ৬ষ্ঠ ও ১৫তম। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ, নদীশাসন ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা প্রভাবজনিত কারণে দুর্যোগে বাংলাদেশের বিপদের আশঙ্কা কয়েকগুণ বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ে দুর্যোগগুলোর ফলে একদিকে যেমন জানমালের ক্ষতি হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে তার উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত