সারা দেশে বাড়ছে শীত কাঁপছে মানুষ

* তাপমাত্রা নামল ৯.৯ ডিগ্রিতে * উত্তরাঞ্চলে বাড়বে কুয়াশা * কাল থেকে কমতে পারে দিন ও রাতের তাপমাত্রা : আবহাওয়া অধিদপ্তর

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর তুলনায় উত্তরের জেলায় শীতের মাত্রা বেড়েছে। কোথাও কোথাও হাড় কাঁপানো শীত নেমেছে। পশ্চিমা বায়ু হিমালয়ের নিচের দিকে নামায় ঘন কুয়াশা ও কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে। গতকাল উত্তরাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চল হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত কুয়াশা ও শীতল বাতাসের প্রবাহে তাপমাত্রা নিচের দিকে নামে। শীতের এই তীব্রতা সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে।

আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশবিদরা বলছেন, তাপমাত্রা বেশি থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে উঞ্চতাও বেশি থাকে, আবার তাপমাত্রা কমলে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি শীত অনুভূত হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে কুয়াশা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণে শীতকালে বাংলাদেশ থেকে সূর্যের অবস্থান দূরে চলে যায়। এ সময়ে দিন ছোট আর রাত বড় থাকে। প্রথমত, সূর্যের দূরত্বের কারণে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত উত্তপ্ত হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, দিন ছোট হওয়ায় ধরণী উত্তপ্ত না হতেই রাত নেমে আসে। ফলে বাংলাদেশে এই সময়ে শীতের অনুভূতি তীব্র হয়। কিন্তু হিমালয়সহ সাইবেরিয়ান অঞ্চল থেকে যদি শীতল বায়ুপ্রবাহ বাংলাদেশে বেড়ে যায় তখন শীতের অনুভূতিও বেড়ে যায়।

গতকাল ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এবারের শীত মৌসুমে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। উত্তরের জেলা নওগাঁর বদলগাছীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়াও দিনাজপুরে ১০ ডিগ্রি, রাজশাহীতে ১১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানিয়েছেন, গতকাল সারদেশে অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক ছিল। এছাড়াও শেষরাত থেকে ভোর পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়েছে। কাল থেকে দিন ও রাতের তাপমাত্রা আরো কমতে পারে। এসময় উত্তরাঞ্চলে ঘন কুয়াশা থাকতে পারে।

সারাদেশে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় মাঝারী থেকে তীব্র শীতের অনুভব হচ্ছে। গতকাল দেশের উত্তরের জনপদ পাবনার ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। যা এ বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিসেবে রেকর্ড গড়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই আশপাশের অন্যান্য উপজেলার চেয়ে ঈশ্বরদীর তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম রেকর্ড করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সন্ধ্যা নামার আগেই শীত জেকে বসছে এ জনপদে। রাতে কনকনে শীতের পাশাপাশি ঘন কুয়াশার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে। সকালে সূর্যের দেখা মিলছে অপেক্ষাকৃত দেরিতে। যার ফলে দুর্ঘটনা এড়াতে আঞ্চলিক এবং মহাসড়কগুলোতে হেডলাইট জালিয়ে চলছে দূরপাল্লার গাড়ি। ঈশ্বরদী আবহাওয়া পর্যবেক্ষক নাজমুল ইসলাম জানান, গতকাল ৬টায় ঈশ্বরদীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা কিনা এ অঞ্চলের মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।

উত্তরাঞ্চলের আরেক জেলা কুড়িগ্রামে জেঁকে তাপমাত্রা নেমেছে ১২.৪ ডিগ্রিতে। কুড়িগ্রামে তীব্র শীত ও কুয়াশায় ব্যাহত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। শীতের সঙ্গে ঘনকুয়াশায় ঢাকা পড়েছে পথঘাট ও প্রকৃতি। দিনের অধিকাংশ সময় সূর্য মেঘে ঢাকা থাকছে। সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত হিম বাতাসে শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হতে থাকে। ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে বিলম্বে যাতায়াত করছে। কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। অন্যদিকে, কুয়াশা ও শীতের কারণে কৃষি শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো বিপাকে পড়েছে। তারা সময়মতো কাজে যেতে পারছেন না। হিমেল বাতাসে তীব্র শীতের কবলে পড়েছে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদ-নদী তীরবর্তী ৩ শতাধিক চর ও দ্বীপ চরের হতদরিদ্র মানুষ।

সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের দিনমজুর কাজিয়ার বলেন, কয়েকদিন থেকে খুব ঠান্ডা ও কুয়াশা। কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। কুয়াশা রাস্তা দেখায় যাচ্ছে না। কাজ করার সময় হাত বরফ হয়ে যায়। কুড়িগ্রাম আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, এ মাসে তাপমাত্রা আরও কমে ২-৩টি শৈতপ্রবাহ এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দিনাজপুরেও ঘন কুয়াশা ও হিমেল বাতাস অব্যাহত রয়েছে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায়, বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ। গতকাল সকাল ৬টায় দিনাজপুরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছরে এটি জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। গত কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হচ্ছে হিমেল বাতাস। আর তার সঙ্গে যোগ দেয় ঘন কুয়াশা।

দিনাজপুরের বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, সকালের দিকে আর সন্ধ্যা থেকে শীতের অনুভূতি বেশি হচ্ছে। সকালে কুয়াশা আর শীতটা বেশি থাকে, বেলা ১০টার পরে শীতের তীব্রতা কমে যাচ্ছে তখন কাজে যাচ্ছি। রিকশাচালক হাবিবর রহমান বলেন, সকাল বেলা মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না, আবার সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বাসায় ফিরছে। কয়েক দিন থেকে ভাড়া কম হচ্ছে। কারণ সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ঠান্ডা বাড়ছে, পরেরদিন সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ঠান্ডা থাকছে।

দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, গতকাল সকাল ৬টায় দিনাজপুরের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৩ শতাংশ। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১ কিলোমিটার। এদিকে ঘন কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়েছে উত্তরের হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঝরছে শিশির। ঘন কুয়াশায় শহরের সড়কগুলোতে হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। একই চিত্র গ্রামের সড়কগুলোতেও। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন অনেকেই। জেলার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার তেঁতুলিয়া অফিস জানায়, গতকাল ভোর ৬টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১০০%।

গত শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনের তাপমাত্রাও নেমে আসে ২৩ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে। প্রথম শ্রেণির তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্র নাথ জানান, গত শুক্রবার থেকে কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়েছে উত্তরের এ জেলা। গতকাল কুয়াশাটা বেশি পড়েছে। তবে তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রির মধ্যেই রেকর্ড হচ্ছে। সকাল ৯টায় তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে। গত শুক্রবার যেখানে সকাল ৯টায় ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল।

ভোর থেকে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঘন কুয়াশার কারণে সড়কগুলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে গতি কমিয়ে চলাচল করছে দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাস, সিএনজি, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন। কুয়াশার সাথে হিমেল বাতাসের কারণে প্রয়োজনের বাইরে বের হতে হচ্ছেন না অনেকেই। তবে খেটে খাওয়া মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে সকালেই বেরিয়েছেন কাজে। সকালে কাজে যেতে দেরি হলে মহাজন কাজে নিতে চান না এমন অভিযোগ অনেক দিনমজুর ও পাথর শ্রমিকদের।

স্থানীয়রা বলছেন, খুবই ঠান্ডা পড়েছে। তার মধ্যে ঘন কুয়াশার কারণে অন্ধকারের মতো লাগছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে ঠান্ডার কারণে। বিশেষ করে এ এলাকাটি বরফের পাহাড় হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছাকাছি হওয়ায় এখানে এ সময়ের প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে হয় আমাদের। রাতে গায়ে কাঁথা-কম্বল নিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে পৌষ মাসের ঠান্ডা শুরু হয়েছে। তেঁতুলিয়ার মাগুড়া গ্রামের শামসুল হক বলেন, মনে হচ্ছে ঠান্ডাটা বেশি পড়েছে। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগেছে। ভোরে দেখছি ঘন কুয়াশা। শিরশির করে ঝরছে শিশির। পাথর শ্রমিক কামাল-নাসির বলেন, কুয়াশা কারণে কাজে যেতে মন না চাইলেও কাজে যেতে হচ্ছে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাঁপলেও জীবিকার তাগিদে পরিবারের কথা চিন্তা করে কাজে বের হয়েছি। কাজ না করলে কী খাব।

ভ্যান চালকরা বলছেন, ঠান্ডা বেশি, তারমধ্যে কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডার মধ্যে সহজে ভ্যানে কেউ চড়তে চান না। কিন্তু কী করবো এই ভ্যান চালিয়ে আমাদের চলতে হয়। এখন পর্যন্ত শীতের কাপড় কিনতে পারিনি। শীতের কারণে জ্বর-সর্দি, কাশিতেও ভুগছি। স্কুল শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিনের চেয়ে গতকাল কুয়াশা পড়েছে অনেক। ঠান্ডাও লাগছে বেশ। কোচিংয়ে বের হয়েছি। ঠান্ডা লাগছে। শীতের কারণে বেড়েছে শীতজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি। উল্লেখ্য, ঘন কুয়াশায় আকাশ থাকায় উত্তর পশ্চিমের শীতল বায়ুপ্রবাহ বেড়েছে। বঙ্গোপসাগরে প্রচুর জলীয়-বাষ্পপূর্ণ বাতাস থাকে এবং আকাশে মেঘমালার সৃষ্টি হয়। উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর আশপাশ এলাকায় অবস্থান করছে। জলীয়-বাষ্পপূর্ণ শীতল বাতাস সাধারণত শীতের তীব্রতা বাড়ায়। ফলে এই বাতাস বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে এলে বাংলাদেশের নিম্নস্তরের বায়ু সেই জলীয় বাষ্প ধারণ করে, এজন্য তাপমাত্রা নিচে নামে।