চাপ সামলে সাফল্যের পথে অন্তর্বর্তী সরকার
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র জনপ্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামলে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর কয়েকটি ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করেছে। বহুমুখী চাপ নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমাজকে সঙ্গে নিয়ে আগস্টের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এসময় সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সফল হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরুদ্ধার হয়েছে। রিজার্ভে হাত না দিয়েই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক পেমেন্ট বাধ্যবাধকতা পূরণ করা হয়েছে। রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এপর্যন্ত দশটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে ঐক্যমত তৈরি করা হবে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার সংস্কার উদ্যোগের জন্য প্রায় সব দেশ থেকে নজিরবিহীন সমর্থন পেয়েছেন। নিউইয়র্ক ও বাকুতে অনুষ্ঠিত বছরের বৃহত্তম বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে তাকে একজন রকস্টারের মতো সম্মানিত করা হয়েছে। বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সংস্থা আট বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রত্যাশা পূরণ। বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে এবং হঠাৎ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সরকার এ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে বিক্ষোভ মোকাবিলা করেছে। বিক্ষোভ দমন করতে খুব কমই বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট কিছু কারখানা মালিক গা-ঢাকা দিয়েছেন, ফলে সরকারকে প্রতিদিনই সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে সরকার সর্বোচ্চ সংযম দেখিয়ে অস্থিরতার অবসান ঘটিয়েছে। কয়েকটি বিধ্বংসী বন্যা এবং মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছে। প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যেকোনো প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় তার সামগ্রিক সক্ষমতা জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছে। মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ১৭টি জেলায় বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেন, ‘সরকার বন্যার সময় প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী, ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় বন্যা দুর্গতদের পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬১টি উপজেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে বের করে আনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি পরিবার খাদ্য সহায়তা হিসেবে ১০০০ টাকা এবং জীবিকা সহায়তা হিসেবে ২০০০ টাকা পাবে।
বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সব সরকারি দপ্তরে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হতে সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা ও মাঠ পর্যায়ের অফিসসমূহকে তালিকাভুক্ত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক (এসইউপি) ব্যবহার বন্ধ ও বিকল্প ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ নির্দেশন বাস্তবায়ন হয়েছে। এছাড়াও দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ও পর্যটন শিল্পকে একসঙ্গে রক্ষা করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এ দ্বীপের প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীরক্ষাসহ কোরাল ব্লিচিং রোধ করতে সেন্টমার্টিন রক্ষা করা হচ্ছে। সেন্টমার্টিন এবং ওই দ্বীপের মানুষের বাঁচানোসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পর্যটন খাতকে সীমিত করেছে সরকার।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিগত শাসনামল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আর্থিক, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন খাতের সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এডিপির অধীনে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও পর্যালোচনা করছি। প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় এবং উচ্চতর রিটার্নের হার রয়েছে এমন প্রকল্পগুলো এখন একনেকে রাখা হচ্ছে... চলমান প্রকল্পগুলোও অব্যাহত থাকবে।’
দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই গত ১৮ আগস্ট ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া খেলোয়াড়দের মান উন্নয়নে ‘বাংলাদেশ স্পোর্টস ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন, যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের হাই পারফরমেন্স, ক্রীড়ার সামগ্রিক সফলতা অর্জন, ক্রীড়াবিদদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্রীড়া কৌশল ও নেতৃত্বগুণ উন্নয়ন তথা সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এই স্পোর্টস ইনস্টিটিউট কাজ করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব/সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য গত ২১ আগস্ট সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরইধ্যে উক্ত কমিটি কর্তৃক একটি খসড়া নীতিমালা উপস্থাপন করা হয়েছে
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার চার মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কাজে গতি ফেরানোর কাজ করছে। ইতোমধ্যে আইন ও বিচার বিভাগের উল্লেখযোগ্য অর্জন এসেছে। এরমধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন গঠনে প্রয়াজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়েছে এবং গঠিত সংস্কার কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ ও সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ সংশোধন বা প্রযোজ্যে ক্ষেত্রে বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে ৫ জন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি এবং অধঃস্তন আদালতে ১০৯ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানসহ আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩ জন বিচারক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটরসহ ১১ জন প্রসিকিউটর নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন অনুবিভাগ, অধিশাখা ও শাখার কার্যক্রমের পুনবিন্যাস এর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ২৩৯ জন আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল) নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। বিজিবির বিস্ফোরক মামলার জন্য ২০ জন ও ৩১ জেলার অধস্তন আদালতসমূহে ২৬৮৫ জন আইন কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট জেলাসমূহে আইন কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে দায়েরকৃত প্রায় সকল ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো চিহ্নিত করে প্রত্যাহারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
