ঢাকা ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভ্যাটের বোঝায় চ্যাপ্টা মানুষ

ভ্যাটের বোঝায় চ্যাপ্টা মানুষ

এক হাজার টাকার খাবার খেলে ভ্যাটই দিতে হবে ১৫০ টাকা! আর বার্গার বা পিজ্জা খেলে সেই ভ্যাট গিয়ে দাঁড়াবে ২৫০ টাকা। ভ্যাটের এমন চাপে ক্ষুব্ধ গ্রাহক ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে অতিরিক্ত ভ্যাটের বোঝা বাড়তি চাপ। গতকাল দুপুরে ধানমন্ডির এক রেস্টুরেন্টে খেতে আসেন জেসমিন ফারিয়া। খাবার অর্ডার করা আগ মুহূর্তে জানতে পারেন অতিরিক্ত ১০ শতাংশ ভ্যাটের কথা। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, পাঁচ শতাংশ ভ্যাট থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হয়ে যাওয়া পকেট কাটার শামিল। মানসম্পন্ন রেস্টুরেন্টের খাবারের ওপর বৃহস্পতিবার ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। অর্থাৎ, ১ হাজার টাকার খাবার খেলে ১৫০ টাকা দিতে হবে ভ্যাট। যা আগে ছিল পাঁচ শতাংশ বা ১ হাজার টাকায় ৫০ টাকা। অর্থাৎ, এখন থেকে হাজার টাকার খাবারে অতিরিক্ত গুণতে হবে আরো ১০০ টাকা।

শুধু রেস্টুরেন্টই নয়, টিস্যু পোশাক, ড্রাইফুড কিংবা জুস খেলেও বাড়তি ভ্যাট গুণতে হবে এখন থেকে। কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার। বছরের পর বছর যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সেভাবে বাড়ছে না আয়। ফলে আয়ের সঙ্গে ব্যয় না মেলাতে পেরে বিপাকে ভোক্তারা। ঠিক এ সময়ে নজিরবিহীনভাবে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বাড়ালো এনবিআর। সরকার গত বৃহস্পতিবার হোটেল-রেস্তোরাঁ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ওষুধ, কোমল পানীয়, সিগারেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ালো। সরকারের এই সিদ্ধান্তর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শিল্পে গ্যাসের দাম, ওষুধ, গুঁড়া দুধসহ ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অংশীজনদের সঙ্গে কোনোরকম পূর্ব আলোচনা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্তে অনেকটাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ভ্যাট বাড়ানোর যে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে তার চাপ পড়বে আমাদের এবং ক্রেতাদের ওপর। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানোর অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রায় ৩ বছর ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। শুধু দরিদ্র মানুষের কষ্ট হচ্ছে কি না, আলোচনাটি এ রকম অবস্থায়ও নেই। যারা মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ তাদের জন্যও এটা খুবই চাপের হয়ে গেছে। এ রকম সময়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত আমি মনে করি না যে ঠিক হয়েছে। এটা সম্পূর্ণভাবেই আইএমএফের যে শর্ত আছে, সেই শর্তের চাপের কাছে নতি স্বীকার করা হলো। এটাতে হয়তো অনেকেই দ্বিমত করবে না যে ভ্যাটের হারকে একক হার করার বিষয়টি আমাদের মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য ছিল। কিন্তু বিরাজমান পরিস্থিতির মধ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনভিপ্রেত। বাংলাদেশে কর ফাঁকির পরিমাণ অনেক বেশি, সামর্থ্যবান মানুষের অনেকেই সঠিকভাবে কর দেন না। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে অনেক ধরনের ছাড় রয়েছে, সেগুলোকে হয়তো যৌক্তিক করা যেত। কর ফাঁকি রোধ করা সরকারের ১ নম্বর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল। এর পরই অগ্রাধিকারে থাকা উচিত প্রত্যক্ষ করহারের যৌক্তিকীকরণ।

সেদিকে না গিয়ে মূলত আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী যে কর আহরণ করা যাচ্ছে না, সেটার অংশ হিসেবেই এমন সিদ্ধান্ত। এটা সাধারণ মানুষকে চাপের মধ্যে ফেলবে এবং তাদের অসহিষ্ণুতাকেও বৃদ্ধি করবে। সার্বিকভাবে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি মানুষের সমর্থনের ওপরও এ সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, যেসব পণ্যের ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অধ্যাদেশ জারি হয়েছে সিগারেট বাদে প্রত্যেকটি পণ্য জীবনমানের সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয়। সেক্ষেত্রে এগুলোর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনমানের ব্যয় বেড়ে যাবে। তখন মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে।

রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩০-এর ঘরে বেতনে চাকরি করেন ইমন হাওলাদার। সরকারের এই অধ্যাদেশ জারির ফলে তিনি খুব চিন্তিত। তিনি জানিয়েছেন, নিত্যপণ্যের যে দাম এই বেতনে হিমশিম খেতে হয়। তারপরও আবার নতুন করে এসব পণ্যের দাম বাড়ার ফলে খুব কষ্ট হয়ে যাবে আমার জন্য। শামসুল আরেফিন নামে আরো একজন বেসরকারি চাকরিজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আমরা যারা মধ্যবিত্ত আছি অনেকে বিনোদনের অংশ হিসেবে রেস্তোরাঁয় পরিবার খেতে যাই। মাস দুয়েকের মধ্যে এক বা দুবার।

রেস্টুরেন্টেও নাকি ভ্যাট বাড়িয়েছে। তাতে ছয় মাসেও পরিবার নিয়ে ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে পারব মনে হয় না। ইমন হাওলাদার, শামসুল আরেফিনের মতো মধ্যবিত্তদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইন্টারনেট, মোবাইল কল রেটে এ ভ্যাট বসানোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন এমনিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল বাড়ে কদিন পরপর। তরপর নিত্যপণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এখন নতুন করে আরো পণ্যের দাম বাড়াতে সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এসব বোঝা সামাল দিতে আমাদের আরো অনেক মূল্য দিতে হবে।

দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই নতুন করে গত বৃহস্পতিবার রাতে এসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক (এসডি) বাড়িয়ে দুটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে এসব পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে। যেমন মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খরচ বাড়বে। পোশাক কেনার ক্ষেত্রে যোগ হবে বাড়তি খরচ। স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ, ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। তবে এলপি গ্যাসের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ২ শতাংশ বাতিল করা হয়েছে।

ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে যেসব পণ্যে ও সেবায় : কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়াল, সানগ্লাস, নন-এসি হোটেল, মিষ্টান্ন ভান্ডার, প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা, নিজস্ব ব্র্যান্ড-সংবলিত তৈরি পোশাকের শোরুম বা বিপণিবিতান- এসব পণ্য ও সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ শতাংশ। বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী (সিনেমা হল), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, স্বয়ংক্রিয় বা যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলা আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, বোর্ড সভায় জোগানকারী, টেইলারিং শপ ও টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, সামাজিক ও খেলাধুলাবিষয়ক ক্লাব ইত্যাদি সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ শতাংশ।

এছাড়া পটেটো ফ্ল্যাকস, কর্ন, মেশিনে প্রস্তুত বিস্কুট, হাতে তৈরি বিস্কুট, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট বা টমেটো কেচাপ বা সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প, তেঁতুলের পেস্ট, ট্রান্সফরমারের তেল, লুব্রিকেন্ট তেল, এলপি গ্যাস, আমদানি করা বাল্ক পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, বিআরটিএ থেকে নেয়া লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, কঠিন শিলা, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো-সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন অ্যালয়, এইচআর কয়েল থেকে সিআর কয়েল, সিআর কয়েল থেকে জিপি শিট, জিআই তার, ৫ কেভিএ থেকে ২ হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, চশমার মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি ম্যাট্রেসে। এসব পণ্যের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ, ইনভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত