ঢাকা ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকার নদীর হালচাল

জনসংখ্যার ঘনত্বে বাড়ছেই দূষণ

* শিল্পবর্জ্যে নদী দূষণ * ঢাকাকে বাঁচাতে হলে প্রাণ ফেরাতে হবে নদীগুলোর * নদীতে ভারী ধাতুর দূষণ ভয়ানক
জনসংখ্যার ঘনত্বে বাড়ছেই দূষণ

জনসংখ্যার ঘনত্বে বিশ্বের অন্যান্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এই শহরে প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানা ও বসবাসরত মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত পলিথিন, প্লাস্টিক-অপচনশীল বর্জ্য অবাধে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্মা, বালু ও ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে পানি দূষণের পাশাপাশি নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর ও কারখানার তরল বর্জ্যে নদ ও খাল-বিলের পানি দূষিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

ঢাকার চারপাশ ঘিরে রেখেছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্ম্যা ও বালু নদী। এসব নদীর পাড় ঘেষে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার উৎপাদিত বর্জ্য হরদম নদীতে মিশছে। প্রতিদিন শতাধিক পয়েন্টের মাধ্যমে গৃহস্থালি, শিল্পবর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। এরমধ্যে টঙ্গীর কামাড়পাড়ার প্রত্যাশা ব্রিজ থেকে পাগাড় পর্যন্ত প্রায় ২২টি ডাইং ও ওয়াশিং কোম্পানির কারখানা থেকে দূষিত রঙিন পানি সরাসরি তুরাগে পড়ছে। প্রকৃতপক্ষে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী এবং টঙ্গী খালে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য প্রধানত ৯টি শিল্পঘন এলাকাণ্ড টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে আসে। ঢাকার চারপাশের নদী দূষণরোধে অন্তর্বর্তী সরকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

নদী দূষণরোধে গত বছরের ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেকের সঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে উপদেষ্টা বলেছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেশের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলো এবং দূষণকারী কোম্পানিগুলোর তালিকা প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে, খাল পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে এবং জলাধার উদ্ধারের কার্যক্রম শুরু হবে। উপদেষ্টা আরো উল্লেখ করেন, নদী সুরক্ষার জন্য ছোট পরিসরের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন? নদীগুলোর ওপর বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনার পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন।

নদীর পানি দূষণে মাছ ও পোকামাকড়সহ কোন প্রাণীই সহজে বেঁচে থাকতে পারছে না। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা একটি। এই নদীর পানিতে ক্ষতিকর পদার্থ ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু রয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)’র বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণরোধে ২০১৯ সালে এক কর্ম পরিকল্পনার প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়। বিআইডব্লিউটিএ’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্মা, বালু, তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদী প্রতিদিন মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। এই দূষণের ফলে নদীর পানি তার স্বাভাবিক রঙ হারিয়ে ফেলেছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি বুড়িগঙ্গাকে। ঢাকার চারপাশের আরো চারটি নদী তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু এবং আরেকটু দূরের ধলেশ্বরীও অবাধ দখল আর দূষণে মৃত্যুশয্যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দুরবস্থাকে আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না। নদীগুলোর সুরক্ষায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমাগত ব্যর্থ। পরিবেশ অধিদপ্তরের কেবল পরিসর বেড়েছে, কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। তবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রস্থল ঢাকাকে বাঁচাতে হলে প্রাণ ফেরাতে হবে নদীগুলোর, এর কোনো বিকল্প নেই। বৃহত্তর ঢাকায় অশোধিত শিল্পবর্জ্য পানি নিস্কাশনের কারণে স্বাস্থ্য, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে বছরে বাড়ছে।

গত বছরের ১২ জুলাই ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ’-এ প্রকাশিত গবেষণায় ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০টি ভারী ধাতুর (এএস, পিবি, সিডি, সিআর, এফই, এমএন, সিইউ, সিইউ, সিও, এনআই, জেডএন) দূষণের প্রবণতা পরীক্ষা করে দেশের জলপথের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গত দুই দশকে বাংলাদেশের নদীগুলোতে ভারী ধাতুর কারণে দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ একটি একাডেমিক জার্নাল। এটি জার্মানিভিত্তিক স্প্রিংগার নেচারের শাখা স্প্রিংগার প্রকাশ করে। দেবাশীষ পণ্ডিত ও মোহাম্মদ মাহফুজুল হকসহ একদল বিশেষজ্ঞ প্রিজমা ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করে পদ্ধতিগতভাবে ৫৫টি নথি পর্যালোচনা করেন।

গবেষণার ফলাফল দেখা যায়, ২০০১-২০১০ সালে যে পরিমাণ দূষণ হয়েছিল, সেই তুলনায় গত দশকের (২০১১-২০২০) দূষণের মাত্রা অনেক খারাপ ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো- ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গবেষণায় প্রধানত তিনটি বিভাগের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সেগুলো- ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম। এসব এলাকার নদীগুলোর বেশিরভাগে ভারী ধাতুর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইউএসইপিএ) এবং বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আর্সেনিক (এএস), সীসা (পিবি), ক্যাডমিয়াম (সিডি), ক্রোমিয়াম (সিআর), লোহা (এফই) ও ম্যাঙ্গানিজের (এমএন) গড় ঘনত্ব তিনটি ঋতুতেই গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে যায়। আর গ্রীষ্মের মাসগুলোতে সর্বাধিক দূষণ হয়। ট্যানারি, টেক্সটাইল ও ইলেক্ট্রোপ্লেটিং কারখানাসহ শিল্প কারখানার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা।

এসব শিল্প কারখানা ভারী ধাতুসম্পন? অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে দেয়। এটি পরিবেশগত মারাত্মক সংকট তৈরি করে এবং যা বছরের পর বছর ধরে খারাপ হয়ে চলেছে। গবেষণায় ভারী ধাতু দূষণের একাধিক উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক আবহাওয়া সম্পর্কিত প্রক্রিয়াগুলোর পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কৃষি থেকে সার ও কীটনাশক, খনন, ইলেকট্রোপ্লেটিং, বস্ত্রশিল্প, কয়লা খনি ও শিল্প বর্জ্য যেমন ব্যাটারি ও রং নদীর পানির দূষণের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এসব দূষক বাস্তুতন্ত্রে জমা হয়, যা জলজ জীববৈচিত্র্য, মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে।

বুড়িগঙ্গার ৬ কিলোমিটারে ২৫১টি পাইপলাইনে সরাসরি অপরিশোধিত বর্জ্য মিশছে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) পরিচালিত ‘ঢাকা নদীর দূষণ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গবেষণায় বাম তীরে (পুরান ঢাকা) ১৩৭টি এবং ডান তীরে (কেরানীগঞ্জের দিকে) ১১৪টি পয়োনিষ্কাশন লাইন পাওয়া গেছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গার নিকটবর্তী নদীগুলোতে অতিরিক্ত দূষণের উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে তুরাগ নদীর সঙ্গে ৯৯টি এবং বালু নদীর সঙ্গে ১০টি অপরিশোধিত বর্জ্য সংযোগ এবং তুরাগ নদীতে ১৩১টি, টঙ্গী খালে ৫১টি ও বালুতে ৩২টি বর্জ্য ফেলার সংযোগ পাওয়া গেছে। আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেছেন, মাঠপর্যায়ে তদন্তের মাধ্যমে পয়োনিষ্কাশনের সংযোগগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পাইপলাইন পাগলা পয়োশোধনাগারে (এসটিপি) স্থানান্তরের পরামর্শ দেন তিনি। এজাজ বলেন, যদি ২৫১টি পয়োনিষ্কাশন সংযোগ বন্ধ করা যায়, তাহলে বুড়িগঙ্গা নদীর ৩০-৪০ শতাংশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের প্রাথমিক উৎস অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন, শিল্প বর্জ্য, বর্জ্য ফেলার পয়েন্ট এবং পানির যানবাহন থেকে নির্গত বর্জ্য। পয়োনিষ্কাশন নিয়ন্ত্রণ না করলে নদীর পানি কখনোই পরিষ্কার বা ব্যবহারযোগ্য হবে না বলেও জোর দেন তিনি। এসব সংযোগ থেকে অপরিশোধিত পয়োনিষ্কাশন কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন? স্থানে ছোট থেকে মাঝারি পয়োশোধনাগার (এসটিপি) স্থাপনের পরামর্শ দেন এই পরিবেশবিদ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত