প্রশাসনকে আওয়ামীমুক্ত করতে কঠোর অবস্থানে সরকার

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসনকে রাজনীতি, দলাদলি, হিংসা-বিদ্বেষ ও চাটুকারিতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের গত ছয় মাসে প্রশাসন চলেছে ঢিমেতালে। এখন ভারসাম্যহীন প্রশাসনে গতি ফেরাতে বঞ্চিতদের অগ্রাধিকার দিয়ে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের কম গুরুত্ব পদে পদায়ন করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

জানা গেছে, সরকারি কর্ম কমিশনের সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব শফিউল আজিম, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিলুর রহমান, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ, পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল এবং ড. নাহিদ হোসেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মশিউর রহমান ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খায়রুল আলম শেখসহ বহু কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ পদেও বদলি করা হয়। এছাড়া বিগত সাড়ে ১৫ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরিচ্যুত প্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে সচিব পদে ১১৯ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, গ্রেড-১ পদে ৪১ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জনকে পদোন্নতি পেয়েছেন। যার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও প্রশাসনের বঞ্চিতরা সুবিধা পেলেন বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমান ও সাবেক আমলারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত দেড় দশকে জনপ্রশাসনে প্রায় দেড় গুণ বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব করেছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিব হিসেবে শূন্যপদের চেয়ে দুই গুণেরও বেশি পদোন্নতি দেয়। জনপ্রশাসনের নিয়মের তোয়াক্কা না করে বড় একটি অংশকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল।

জনপ্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা গত ছয় মাসে প্রশাসনে ঠিকমতো কাজ করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিভিন্নভাবে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। সেজন্য ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়ন, সেবা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রশাসনকে আওয়ামীমুক্ত করতে শক্ত অবস্থান নিয়েছে ইউনূস সরকার। এরইমধ্যে বিভিন্ন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর ও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। কারণ, প্রশাসনে আওয়ামী প্রেতাত্মারা পতিত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনে ষড়যন্ত্র করতে পারে। অবিলম্বে প্রশাসনকে আওয়ামীমুক্ত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জনপ্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার তিন মাসের মাথায় সহকারী সচিব থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যন্ত ৮০ জন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। এছাড়া ১০১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। এভাবে গত ছয় মাসে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সংস্কারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ক্ষমতায় আসা ইউনূস সরকার প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আর রদবদল শুরু করেছে। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী লীগের মতাদর্শের কর্মকর্তারা যাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক অবস্থানে আছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোসহ বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ১ হাজার ৮৭০ জনকে বদলি করা হয়েছে। এছাড়াও জ্যেষ্ঠ সচিব/সচিব পদের ১২ জন, গ্রেড-১ পদের তিনজন, অতিরিক্ত সচিব পদের ১৩৫ জন, যুগ্মসচিব পদের ২২৬ জন, উপসচিব ১২৫ জন, অন্যান্য ক্যাডারের ২২১ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) ৯ জন এবং সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) ৩৭ জনসহ সর্বমোট ৭৬৮ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আর ৬৫ জনকে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, যুগ্ম সচিব ও তার উপরের পদের কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে ছয় সদস্যের ‘জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটি’ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করা হয়েছে। কমিটিতে আরো আছেন- বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব। কমিটির সদস্যসচিব তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এ কমিটির সদস্য। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে, এ কমিটি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে তথ্য চাইতে পারবে।

সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান সংবাদ সম্মেলনে জানান, জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে আবারও পদোন্নতি দেয়া হবে। আর ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন, তাদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে, তাদের গ্রেড-১ দেয়া হবে।

জনপ্রশাসনের বিষয়ে সাবেক সচিব মো. শহীদ খান বলেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়েছে। পদোন্নতি-পদায়নের লোভে ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছেন, পরবর্তীতে তারাই পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দলীয়করণের ফলে প্রশাসনে যে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে পুলিশ, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সেবা খাতগুলোতে দলীয়করণ করায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠে প্রশাসনকে পুনরায় নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে।