নির্বাচন আসলে কবে
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আমিরুল ইসলাম অমর

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সব মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেউ বলছেন, চলতি বছরের শেষে ডিসেম্বরে ভোট হবে। কেউবা বলছেন, ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভোট হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও কিছু সংস্কার করতে হলে ভোট হতে দেরি হবে। এরইমধ্যে আগামী ডিসেম্বরে ভোট হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন আরো কয়েকজন উপদেষ্টা। তবে, কোনো কোনো উপদেষ্টা বলেছেন, কিছু সংস্কার করতে হলে ভোট হতে কিছুটা সময় লাগবে। আবার কেউ কেউ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন আরো পেছাতে পারে। সব মিলিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আসলে কবে হবে, এমন প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সঙ্গে যারা আছেন তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, অতি দ্রুত তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেনও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আশা করব, জনগণের যে প্রত্যাশা আছে, একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন তিনি। সেটার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপি আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াত গুরুত্ব দিয়েছে সংস্কারে। ওই সময় অনুষ্ঠিত সংলাপে নানা সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ওই সময় সংলাপ শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমাদের দেয়া দুটি রোডম্যাপের মধ্যে একটি হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলেই নির্বাচন সফল হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি জাতীয় নির্বাচন আগে হতে হবে, তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম সভায় মিলিত হয়েছেন। এ সভায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, সংস্কার যে করা প্রয়োজন সে বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। দলগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সংস্কারের যে রিপোর্টগুলো কমিশনগুলো যে জমা দিয়েছে সেগুলোর ওপর আলাপ-আলোচনা হবে। দলগুলো এ নিয়ে কমিশনগুলোর সঙ্গে কথা বলবে এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সেটাই মূল কথা। সেখানে আজ প্রাথমিক আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা আশা করব এ সংস্কারের ন্যূনতম যে ঐকমত্য তৈরি হবে সেটার ওপর ভিত্তি করে অতি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ইসির প্রস্তুতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমরা বলেছিলাম আমাদের আর্লিয়েস্ট ডেটটা ধরে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আমাদের অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত। আমরা ডিসেম্বর ধরেই প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। আমাদের ভিন্ন প্রস্তুতি নেই, একটিই প্রস্তুতি (জাতীয় নির্বাচন)।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করার বিষয়ে সরকারের অনুরোধ এলে ইসি বিষয়টি সম্ভব কি না বিবেচনা করতে পারে বলে মনে করেন তিনি। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাঁচ স্তরের স্থানীয় নির্বাচন করতে হলে এক বছরের মতো সময় লাগে। আমাদের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়নি, কিছু হয়েছে। এ কন্ডিশনাল বিষয়গুলো নিয়ে স্পেসিফিক টাইমলাইন দেয়া সম্ভব নয়। আমরা ধারণা করি, সরকার তো আমাদের হাতের টাইমগুলো বিবেচনায় নেবেন এবং তারা যদি মনে করেন জাতীয় নির্বাচন কোনো একটা টাইম ফ্রেম করে তারপর কতটুকু অনুশীলন করা যায় তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন।
এদিকে, সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গত সোমবার নগর ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি। আসিফ মাহমুদ বলেন, সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার মধ্যে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সূত্রমতে, বিএনপিসহ কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর জোর দেয়। তবে বিএনপি দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দাবি করে আসছে। জামায়াতে ইসলামী শুরুতে নির্বাচনের তাগিদ না দিলেও গত কয়েক দিনে দলটির আমির শফিকুর রহমান দুবার দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলেছেন।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যরা বরাবরই বলে আসছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন হবে। তবে সংস্কার কতটুকু হবে, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।
রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্র বলছে, নির্বাচন কবে হবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা না এলেও বিষয়টি এখন সব মহলে আলোচিত। হয়তো সামনের দিনগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে একটা সময়সীমা পাওয়া যাবে।
গত ২১ নভেম্বর অবসরপ্রাপ্ত সচিব এএমএম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের প্রশ্নে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ৩১ অক্টোবর সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকেই নতুন ইসি গঠন করা হয়। গত ১৭ নভেম্বর সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। তবে নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যেতে যেতে অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে- এটা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা আসলে সংস্কারকাজের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সংস্কার কতটুকু করা হবে, এর ওপরই নির্বাচন কবে হবে তা নির্ভর করছে।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় কোন কোন খাতে কী কী সংস্কার করা হবে, তা ঠিক করা হবে। সংস্কারের জন্য কত সময় লাগবে, সেই সময়সীমারও ধারণা পাওয়া যাবে। তখনই আসলে নির্বাচন কবে সম্ভব, এর একটা প্রকৃত সময় জানা যাবে।
সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৯ নভেম্বর আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব। আমরা জাস্ট এই জিনিসটা চাই না যে, আগের মতো কোনো ভুয়া নির্বাচন হোক। আর এটা চাই না- নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কেউ আবার ভুয়া নির্বাচন করার সুযোগ পাক। এটা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নাই।’
এরপর ২১ নভেম্বর যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে সরকারের নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি কাঙ্ক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পরবর্তী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণার কথা জানান। সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বারবারই বলছে, দ্রুত নির্বাচন না হলে দেশের সংকট কাটবে না। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন নিয়ে এত দিন তাগাদা না দিলেও দলটির আমির প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দেয়া উচিত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, স্থানীয় নয়, অবশ্যই জাতীয় নির্বাচন আগে হতে হবে। নির্বাচন প্রলম্বিত করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। রুহুল কবির রিজভী বলেন, শেষ ১৭ বছরে অবাধ সুষ্ঠু এবং সর্বজন গ্রাহ্য যে নির্বাচন সেই নির্বাচনের যে ভয়ংকর পরিণতি আমরা দেখতে পেয়েছি সেটা তো হওয়ার কথা ছিল না। ৯০ আন্দোলনের যে স্পিরিট ছিল তা থেকে আবারো হোঁচট খেয়ে ব্যাক ট্রেকিং হবে সেটা তো কেউ প্রত্যাশা করেনি। শুধু ব্যাক ট্রেকিং নয়, এমন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বিগত ১৭ বছরে সেটা তো বিস্ময়কর। এজন্য রাজনৈতিক বিজ্ঞানে পলিটিক্যাল সায়েন্সে নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। একতরফা এক ব্যক্তির নির্বাচনের জন্য কীভাবে রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দিনের ভোট রাত্রে হয়েছে। ভোটারদের মাইকিং করে ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রগুলোর সামনে চতুষ্পদ জন্তুর পদচারণা আমরা লক্ষ্য করেছি এই ধরনের নির্বাচন আমরা দেখেছি বিগত ১৬-১৭ বছরে।
