সাবেক মন্ত্রীরা কারাগারে এপিএসরা অধরা
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন সহকারী একান্ত সচিবরা (এপিএস)। বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে শুরু করে এমপিদের নিজ সংসদীয় আসনেও অনিয়মের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এপিএসরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে এমপিদের মামলা গ্রেপ্তারের আওতায় এলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন এপিএসরা।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালালেও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ফারুক খান, দীপু মনি, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, গোলাম দস্তগীর গাজী, আমির হোসেন আমু, কামরুল ইসলাম, সাবেক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলমসহ বহু মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মন্ত্রীরা গ্রেপ্তার হলেও তাদের এপিএসরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
রাজনৈতিক বিবেচনায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে তাদের বিশ্বস্তদের নিয়োগ দেন, তাদের মাধ্যমে মন্ত্রীরা দুর্নীতি করেন। দুর্নীতির তথ্য ফাঁস রোধে কিছু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আত্মীয়দের এপিএস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পুরো মন্ত্রণালয় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মন্ত্রীদের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেন এপিএসরা। কিনেছেন দামি গাড়ি, গড়েছেন বাড়ি। মন্ত্রী-এমপির নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার দাপট, টেন্ডার, কমিশন ও তদবির-বাণিজ্য এবং চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির কারবার করে বিত্তশালী হয়েছেন এপিএসরা। ২০০৮ সালের আগে এসব এপিএস ও তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ থাকলেও, ক্ষমতার পরশ পাথরের ছোঁয়ায় সেই চিত্র বদলেছে দ্রুতই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রীরা নিজেরা অনিয়ম করে রাজধানীর বুকে বহুতল ভবন করেছেন, ঠিক তেমনি তাদের এপিএসরাও রাজধানীর বুকে বাড়ি, চড়েন দামি গাড়িতে। নিজ এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেন। মূলত মন্ত্রীর কাছে যাওয়া সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা শোনা এবং প্রয়োজনে সেগুলোর সমাধান করা এপিএসদের কাজ। এ কাজ করতে গিয়েই অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তারা। কখনও মন্ত্রীর জ্ঞাতসারে, কখনও অজ্ঞাতসারে সম্পদ আহরণ করে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এপিএসের নিজেদের সুবিধার্থে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দিয়েই পরিচালিত হয় পুরো মন্ত্রণালয়। ডিও লেটার, সুপারিশ-বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলিসহ ক্ষমতাকেন্দ্রিক লুণ্ঠন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হওয়া, টেন্ডার, টিআর, কাবিখা, সামাজিক নিরাপত্তার বয়স্ক ভাতাসহ সব কর্মসূচি এপিএসদের মাধ্যমেই হয়।
সচিবালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রীদের নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠরা এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সুযোগে বখাটে, নানা জায়গায় ধান্দা করে বেড়ান এপিএসরা। সরকারি বেতন-ভাতা, অফিসকক্ষ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা। এসব ব্যবহার করে রাতারাতি বনে যান বাড়ি-গাড়ির মালিক। তাদের আয়ের উৎস থাকে অজানা। বেশিরভাগ দুর্নীতি, অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকেন এপিএসরা। আর ক্ষমতার পটপরিবর্তনে জেলে যান মন্ত্রীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের নজর তাদের এপিএসদের উপর ছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) গাজী হাফিজুর রহমান লিকু ও তার স্ত্রী রহিমা আক্তারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। এছাড়া নামে-বেনামে নিজের ও বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের নামে বিপুল সম্পদ রয়েছে লিকুর। তার অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে বলে দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। ?স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সেখ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনের এপিএস শেখ কুদ্দুস, জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের এমপি আলহাজ শামসুল হক চৌধুরীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএ) এজাজ চৌধুরী, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত আরো কয়েকজন এপিএসের নামও রয়েছে দুদকের তালিকায়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মনির হোসেনের সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের এপিএস ছিলেন তার ছোট ভাই মো. সাহাবুদ্দিন। তার মেয়ে শামীমা সুলতানা হৃদয়কে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক, হৃদয়ের স্বামী মেহেরাব পাটোয়ারীকে সহকারী পরিচালক এবং বোনের ছেলে এএম ইয়াসিনকে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সহায়তায় গঠিত কেন্দ্রীয় তহবিলের সহকারী পরিচালক পদে চাকরি দেয়া হয়। নিয়োগের পর তাদের মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। আর তারা পুরো মন্ত্রণালয় নিজেদের কবজায় নেন। পরে তারা সিন্ডিকেটে করে কয়েকশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন, যাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা হয়েছে। মনির হোসেনের মতোই সাবেক মন্ত্রীদের বেশিরভাগ এপিএসরা দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর যাদের সহযোগিতায় মন্ত্রীরা এসব করেন, সেই এপিএসরা ঘাপটি মেরে আছেন। এত মন্ত্রী গ্রেপ্তার হলেও তাদের সঙ্গী এপিএসরা কোথায়। অথচ মন্ত্রী ও এপিএস একইসূত্রে দুর্নীতিতে গাথা।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দায়িত্ব যতদিন তাদের এপিএসদের চাকরির মেয়াদ ততদিন। সেজন্য মন্ত্রী ও এপিএসরা আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন। এপিএসরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে দর কষাকষিতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে থাকেন। ফলে তারা দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পান। এপিএস নিয়োগের এ প্রথা বাতিল করতে হবে।
