বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আবুল কাসেম ফজলুল হক

রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষা কমিটি রাষ্ট্রব্যবস্থার সব পর্যায়ে বাংলা চালু করার এবং এ ভাষার সর্বাঙ্গীন উন্নতির লক্ষ্যে সামান্য প্রচার চালাচ্ছে। এর মধ্যেই কিছু লোক এই কার্যক্রমকে ইংরেজিবিরোধী বলে অভিহিত করছেন। তারা আমাদের উদ্দেশ্যকে বোঝার চেষ্টা না করেই অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করছেন। ইংরেজি ভাষার রয়েছে সুবিশাল জ্ঞানভাণ্ডার।
ইংরেজি শিখে সেই জ্ঞানভাণ্ডার থেকে উন্নত প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করে বাংলা ভাষার জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পাশ্চাত্য প্রযুক্তি গ্রহণের জন্যও ইংরেজি অপরিহার্য। আমরা ইংরেজির বিরোধী নই। আমাদের ধারণা, কেবল কাণ্ডজ্ঞানহীনরাই ইংরেজির বিরোধিতা করতে পারে। ইংরেজি ছাড়াও আরো কিছু উন্নত ভাষা শেখার ব্যবস্থা সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে করা দরকার।
দরকার একটি বৃহদায়তন রাষ্ট্রীয় অনুবাদ সংস্থা, যাতে ক্লাসিকের ও গুরুত্বপূর্ণ সমকালীন বিষয়াদির অনুবাদের দ্বারা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করা ও জাতীয় প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশ যদি প্রকৃত উন্নতির পথে চলতে চায়, তা হলে প্রাত্যহিক কাজ চালানোর জন্যও অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় অনুবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। দরকার বাংলা একাডেমির পাশে বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের মতো আর একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেখা দরকার ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি। দেখা দরকার ইংরেজি এত উন্নত ভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা তাদের জাতীয় ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না।
দেখা দরকার কীভাবে তারা তাদের দেশে ইংরেজির সমস্যার সমাধান করছে। আমরা অনুকরণে যাব না, তবে অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের উন্নতির পথ প্রশস্ত করব। রাষ্ট্রীয় বৈচিত্র্যের মধ্যেও আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সর্বজনীন কল্যাণে বিশ্বাস করি। বাংলা ভাষার উন্নতির সম্ভাবনা অন্তহীন। আমাদের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য বাংলা ভাষাকে অবশ্যই আমাদের উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশে ইংরেজি দিয়ে কিংবা অন্য কোনো ভাষা দিয়ে বাংলার প্রয়োজন মিটবে না। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলার প্রতিষ্ঠা আংশিকমাত্র। বিচারব্যবস্থায় বাংলা প্রচলন দরকার। উচ্চশিক্ষায় বাংলা প্রচলন অনেকখানি এগিয়েছিল, কিন্তু ১৯৯১ সালে বাইরের বৃহৎ শক্তিবর্গের সহায়তা নিয়ে চালু করা গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের কার্যক্রম স্থগিত করে ফেলা হয়েছে।
২০০৪ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মূল ধারার শিক্ষাকে বিভক্ত করে প্রবর্তন করা হয়েছে ‘ইংলিশ ভার্সন’। ইংলিশ ভার্সনে শিক্ষা বাংলা মাধ্যমের তুলনায় খারাপ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা না শিখতে পারছে ইংরেজি, না শিখছে বাংলা, না শিখছে বিষয়। ইংলিশ ভার্সন চালু থাকলে জাতীয় জীবনে এর সুদূরপ্রসারী কুফল দেখা দেবে। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করেছে। তাতে সব রাষ্ট্রের প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর বিলীয়মান মাতৃভাষাকে রক্ষা করার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
ইউনেসকোর এই আয়োজন সম্পূর্ণ ভুল। বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করা যাবে না। আদিবাসীদের মানবজাতির মূল ধারায় আসতে দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের, কানাডার ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের রাষ্ট্রীয় মূল ধারায় আসতে দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশেও ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৪৫টি মাতৃভাষাকে রক্ষা করার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এই ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। সিভিল সোসাইটিগুলোর বিশিষ্ট নাগরিকরা বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীন এবং বিলীয়মান মাতৃভাষা রক্ষায় তৎপর। এই বাস্তবতায় বাংলা ভাষার গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়ামের ‘এ লেভেল’, ‘ও লেভেল’ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইংরেজি শেখানোর আরো নানা আয়োজন আছে। এসবের ওপর আবার ইংলিশ ভার্সন কেন? যারা বিদেশে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহী তাদের জন্য তো ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের ইংরেজি মাধ্যমের আয়োজনই অনেক ভালো। বিশেষ করে ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পর থেকে, একটির পর একটি সরকার বাংলা ভাষার প্রতি এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে আচরণ করে চলেছে তাতে জনজীবন, জাতি ও রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। উন্নয়নের নামে সর্বাঙ্গীন উন্নতি বানচাল হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে করে তোলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারত প্রভৃতি রাষ্ট্রের স্থানীয় দূতাবাস-অভিমুখী। বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে, ওয়াশিংটনকে কেবলা গণ্য করে আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতির যে যাত্রা, তার ফল বাংলাদেশের শতকরা আটানব্বই ভাগ মানুষের জন্য সর্বনাশা। সংস্কৃতির অবলম্বন কেবল নাচণ্ডগান-বিনোদন নয়, সংস্কৃতির অবলম্বন সার্বিক জীবনপ্রয়াস- জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি-অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য, আনন্দ-বিনোদন সবই। বাংলাদেশে বাংলা ভাষাই এই সংস্কৃতির অবলম্বন। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের জনগণের অস্তিত্বের সবচেয়ে মূল অবলম্বন, সবচেয়ে বড় সম্পদ।
এই অবলম্বন, এই সম্পদ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে আমরা কোন গন্তব্যের দিকে চলছি? যারা আমাদের ইংরেজিবিরোধী বলে, নানা অস্বচ্ছ উপায় অবলম্বন করে ইংরেজির অনুকূলে জনমত গঠনে তৎপর আছেন, তারা রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাংলা ভাষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। তারা জাতীয় সংস্কৃতিকে পরিহার করে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের অনুকূলে পরাধীনতার সংস্কৃতি গ্রহণে তৎপর।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের চেয়ে পরাধীনতার মধ্যে বৈষয়িক সম্পদ ও ভোগবাদ তাদের কাছে অনেক বড়। তারা কায়েমি স্বার্থবাদী ও গণবিরোধী। বাংলাদেশে যারা বাংলার প্রতি অবজ্ঞাশীল, বাংলাদেশকে রাষ্ট্ররূপে রক্ষা করার কোনো আগ্রহ তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নিয়ে তাদের কোনো বিবেচনা আছে? আমাদের বোঝা দরকার যে, বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা না থাকলে, বাংলাদেশ রাষ্ট্ররূপে অস্তিত্বশীল থাকবে না।
আমাদের স্বাধীনতা না থাকা, রাষ্ট্র না থাকা কি আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে? আমাদের দরকার একটি প্রকৃষ্ট রাষ্ট্রীয় ভাষানীতি। বাংলা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি ভাষা, ইংরেজি ও অন্যান্য উন্নত বিদেশি ভাষা, সংস্কৃত, পালি ও আরবি প্রভৃতি ধর্মীয় ভাষা-জাতীয় বাস্তবতা ও বিশ্ববাস্তবতা, সবকিছু বিবেচনা করে স্থির করতে হবে জাতীয় ভাষানীতি। বহুত্বমূলক সমন্বয়ের কিংবা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের নীতি অবলম্বন করে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে। বাংলা সমৃদ্ধ ভাষা। দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, পৃথিবীর এমন দুশ’ ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান উপরের দিকেই ছিল।
বিশ্বের অনেক জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা দুর্গতিতে পড়ে আছি। আমাদের উন্নতি করতে হবে। আমাদের উন্নতির সবচেয়ে মূল অবলম্বন হবে আমাদের ভাষা, আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ। বাইরের জগৎ থেকে আমরা গ্রহণ করব আত্মশক্তির ওপর নির্ভর করে, আত্মশক্তিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে হলে এবং রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে বাংলা বানানের আরো সংস্কার করতে হবে।
আমাদের দাবি : ১. ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করুন; ২. বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার সব ধারার, সব স্তরের পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নত করুন; ৩. জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি অবলম্বন করে শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কার করুন; ৪. উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে ও বিচারব্যবস্থায় বাংলা ভাষা চালু করুন; ৫. জাতীয় অনুবাদ সংস্থা ও বাংলা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করুন; ৬. পর্যায়ক্রমে ন্যায় বৃদ্ধি করুন ও অন্যায় হ্রাস করুন; ৭. বাংলাদেশকে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলুন।
লেখক পরিচিতি : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
