মুক্তি পেলেন ৬৪২ ফিলিস্তিনি
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের কূটনৈতিক সাফল্যের পথ ধরে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ৬৪২ ফিলিস্তিনি মুক্তি পাওয়ার পর ফিলিস্তিনে ঈদের আনন্দ চলছে। সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, সর্বশেষ সমঝোতা অনুযায়ী চার ইসরায়েলি বন্দির লাশ হস্তান্তর করেছে হামাস। ইসরায়েলের কারাগার থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে ফিলিস্তিনি কারাবন্দিরা মুক্তি পাওয়ার কিছুক্ষণ পর লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, চার বন্দির লাশবাহী কফিন তারা পেয়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো বলেছে, রেডক্রসের সহায়তায় ফিলিস্তিনি বন্দিদের রামাল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাছাড়া, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের ইউরোপিয়ান হাসপাতালে বন্দিদের বহনকারী ১২টি বাস পৌঁছায় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের উল্লাস করতে দেখা গেছে। অনেককে আনন্দে কাঁদতে দেখা যায়। ইসরায়েলের কাছে হামাস যে চার বন্দির লাশ হস্তান্তর করেছে, তারা হলেন- ওহাদ ইয়াহালোমি, সাচি ইদান, ইতজিক এলগারাত ও সোলোমো মনসুর। ইসরায়েলি গণমাধ্যম তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গত শনিবার ছয় ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেয় হামাস। তাদের সঙ্গে চার বন্দির লাশও হস্তান্তর করে। বিনিময়ে ৬২০ ফিলিস্তিনি কারাবন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল ইসরায়েলের। কিন্তু মুক্তি দেওয়ার সময় হামাস বন্দিদের সঙ্গে ‘অসম্মানজনক আচরণ’ করেছে অভিযোগ তুলে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি স্থগিত করে ইসরায়েল। হামাসের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে সেদিন বলা হয়, আগে ফিলিস্তিনি কারাবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। এরপরই কেবল গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করবে হামাস। শেষ পর্যন্ত হামাসের কূটনৈতিক সাফল্যে কারণে ছয় শতাধিক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন। এর মধ্যদিয়ে গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়া নিয়ে তৈরি শঙ্কার কালো মেঘও অনেকটা কেটেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে টালমাটাল অবস্থার মধ্যে উপত্যকাটি নিয়ে নিজের ট্রুথ অ্যাকাউন্টে একটি আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো এই ভিডিও প্রকাশের পর আরববিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গাজার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এটিকে সাগর তীরবর্তী বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করেছেন তিনি, যেখানে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে একটি সুইমিং পুলের পাশে বসে তিনি ককটেল উপভোগ করছেন। তাছাড়া, তার পরামর্শক ইলন মাস্ক মজার-মজার খাবার উপভোগ করছেন। তার মাথার ওপর ডলার উড়ছে। ভিডিও-র আরেক জায়গায় দেখানো হয়, ট্রাম্প গাজার একটি বারে অর্ধনগ্ন নারীদের সঙ্গে মদ পান করছেন। দেখা গেছে, গাজায় ট্রাম্পের সোনালী রঙের মূর্তি বসানো হয়েছে, আর উপত্যকাজুড়ে তার জয়ধ্বনী চলছে। এক ব্যক্তি এই ভিডিও-র জন্য ট্রাম্পের সমালোচনা করে ট্রুথে লিখেছেন, ‘আমি ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সমর্থক। তবে এই ভিডিও জঘন্য। খুবই জঘন্য।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘আমি এটি ঘৃণা করি। আমি আমাদের প্রেসিডেন্টকে ভালোবাসি। কিন্তু এই ভিডিও ভয়ানক।’ তাছাড়া সোনালী রঙের বিশাল মূর্তি নিয়েও অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। একজন লিখেছেন, ‘এই মূর্তি যীশু-বিদ্বেষী। দয়া করে ইশ্বরের প্রতি অনুগত হোন। যীশুই একমাত্র রাজা।’
গাজার শাসকদল হামাস ট্রাম্পের অলীক কল্পনা প্রত্যাখ্যান করে এক বিবৃতিতে বলেছে, বৃদ্ধ ট্রাম্পকে গাজা দখলের স্বপ্ন বুকে নিয়ে পরপারে পাড়ি জমাতে হবে। সংগঠনের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ও মুখপাত্র বাসেম নাঈম এই ভিডিওর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, গাজা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে পরিকল্পনার কথা বলছেন, তা ফিলিস্তিনিদের সংস্কৃতি ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউজউইককে তিনি বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে, ট্রাম্প আবারও এমন ধারণা দিচ্ছেন, যা এখানকার জনগণের সংস্কৃতি ও স্বার্থকে বিবেচনায় নেয় না।’ বাসেম নাঈম আরও বলেন, ‘গাজার জনগণ এমন এক দিনের প্রত্যাশায় আছে, যখন তারা একটি পুনর্গঠিত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ গাজা দেখবে, যেখানে তাদের সন্তানদের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে। কিন্তু এটি বড় একটি কারাগারের ভেতরে থেকে সম্ভব নয়। আমরা কারাগারের অবস্থা ভালো করার জন্য সংগ্রাম করছি না, বরং কারাগার ও কারারক্ষীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লড়াই করছি।’
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা দখল করার যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, তা দীর্ঘদিনের ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে সাহায্য করবে না, বরং পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের জন্য একটি ‘টাইম বোমা’ হিসেবে কাজ করবে। তিনি বুধবার কাতার সফরে গিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব রয়েছে। সেই প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে যদি ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করা হয়, তাহলে গোটা অঞ্চলের ওপর তার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে একটি টাইম বোমাকে সক্রিয় করা হবে, যা যে-কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বুধবার দোহা সফর করেন ল্যাভরভ। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিগত কয়েক দশক ধরে বিকল্প যে পরিকল্পনাই হাতে নেওয়া হয়েছে, তার প্রত্যেকটি ব্যর্থ হয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে একটি শান্তি চুক্তির পথে ইসরায়েল যে-সব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, তাতে মস্কো উদ্বিগ্ন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি গাজাবাসীকে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা উত্থাপন করেছেন। তিনি গাজাবাসীকে তাড়িয়ে সেখানে একটি সৈকত রিসোর্ট নির্মাণ করতে চান। ট্রাম্পের পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ মঙ্গলবার বলেছেন, গাজায় রিসোর্ট নির্মাণ করার বিষয়ে অচিরেই আঞ্চলিক রিয়াল স্টেট ডেভেলপারদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ হামাসের পরিবর্তে মিসরকে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে কায়রো। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তামিম খালাফ বলেছেন, যে ধারণা বা প্রস্তাবে মিসর ও আরব বিশ্বের গাজা বিষয়ক স্থায়ী নীতি-অবস্থান পরিবর্তন করার কথা বলা হয়, তা অগ্রহণযোগ্য। ওই মুখপাত্র উল্টো ইসরায়েলকে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানান। মিসর একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার যে আহ্বান জানিয়ে এসেছে, তিনি তার পুনরাবৃত্তি করেন। খালাফ বলেন, গাজা উপত্যকা, পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেম স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ এবং এই অংশগুলো নিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর আগে মঙ্গলবার ইয়ার লাপিদ ‘গাজা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর’ এই উপত্যকার ভবিষ্যত নিয়ে একটি পরিকল্পনা উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, চলমান যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হলে মিসরের উচিত গাজার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা। এর বিনিময়ে মিসরের বিশাল ঋণ মওকুফ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন লাপিদ।
আগামী শনিবার শেষ হচ্ছে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপের সময়সীমা। পরবর্তী ধাপের আলোচনার জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠক ডেকেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। বিভিন্ন গণমাধ্যম বলেছে, যুদ্ধবিরতির সময় বাড়াতে এবং উপত্যকায় ত্রাণ পৌঁছানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র। রয়টার্স আভাস দিয়েছে, ইসরায়েল প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়িয়ে বাকি ৬৩ বন্দিকে ফেরত আনতে চায়। গাজায় স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ হবে কিনা, ইসরায়েলি পরিকল্পনায় তা স্পষ্ট নয়। এদিকে, গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি ইসরায়েলের নজিরবিহীন অবহেলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, গাজায় নেতানিয়াহু বাহিনীর সামরিক অভিযান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আলজাজিরা জানিয়েছে, গাজা নিয়ে রুদ্ধশ্বাস অবস্থার মধ্যে পশ্চিমতীরের নূর শামস শরণার্থী শিবির থেকে সবাইকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু বাহিনীর এমন ঘোষণার পর আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেছেন অনেক বাসিন্দা। তারা জানান, শরণার্থী শিবিরের বেশকিছু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা করেছে ইসরায়েল। তবে পশ্চিমতীরের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। বিভিন্ন স্থানে মুখোমুখি লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে।
