রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৬৪৯৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার অফিস

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৬ হাজার ৪৯৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারকে পত্রের মাধ্যমে ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেন এই বন্ধের ঘোষণা দেন। ইউনিসেফ কক্সবাজার ফিল্ড অফিসের প্রধান এনজেলা কার্নে ও সেভ দ্য চিলড্রেনের মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, উখিয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিক্ষা সেক্টরের সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
এর আগে ইউনিসেফ গতকাল সোমবার ২ জুন প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থী শিশু শিক্ষা ঝুঁকিতে রয়েছে। পর্যাপ্ত তহবিল না পাওয়ায় পর্যায়ক্রমে স্থানীয় শিক্ষক স্বেচ্ছাসেবকদের ছাঁটাই করতে হচ্ছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ দৌজা নয়ন চিঠি পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইউনিসেফ পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ১২০০ স্থানীয় শিক্ষককে ছাঁটাই করা হয়। এসব শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় থেকে শিক্ষকদের চাকরি পুনর্বহাল এবং পর্যাপ্ত তহবিল প্রদানের জন্য জাতিসংঘকে বলা হয়েছে। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার কক্সবাজার-টেকনাফ (শহিদ এটিএম জাফর আলম) আরাকান মহাসড়কের উখিয়া উপজেলার কোর্টবাজার স্টেশন চত্বর ও টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং উনচিপ্রাং স্টেশন চত্বরে এই আন্দোলন শুরু হয়। উখিয়া ও টেকনাফ ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ফান্ডে পরিচালিত শিক্ষা প্রকল্পের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৭ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে যানচলাচল বন্ধ ছিল। যার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে সড়কে চলাচলকারী যানবাহন ও যাত্রীদের। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস পেয়ে আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষকরা। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করে জানান, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিক্ষা প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এনজিও সংস্থা ব্র্যাক, কোডেক, ফ্রেন্ডশিপ, মুক্তি কক্সবাজার, জেসিএফসহ শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকদের বহাল রেখে ১২৫০ জন বাংলাদেশি শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করে। যা দাতাসংস্থা ইউনিসেফের ফান্ড সংকট বলে দাবি করে আসছে। শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো হঠাৎ করে একযোগে ১২৫০ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করায় স্থানীয়দের মাঝে নেতিবাচক ধারা তৈরি হয়। যা স্থানীয় উখিয়া টেকনাফের মানুষের সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও প্রহসন মনে করেন অনেকেই। শিক্ষকদের চাকরিতে বহাল রেখে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর দাবিতে স্থানীয় বাংলাদেশি শিক্ষকরা প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ ও আন্দোলনে নামেন। এতে করে মহাসড়কে অ্যাম্বুলেন্সসহ শত শত বিভিন্ন ধরনের দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়লে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। উনচিপ্রাংয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষক মোহাম্মদ করিম বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে ক্যাম্পে পরিচালিত শিশু শিক্ষা কেন্দ্র থেকে রোহিঙ্গা শিক্ষকদের চাকরিতে বহাল রেখে স্থানীয় বাংলাদেশি শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর আগেও চাকরি ফিরে পেতে কয়েক দফা আন্দোলন করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত চাকরিতে যোগদান করতে পারিনি। বিপরীতে নতুন করে আরও ১২৫০ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। উখিয়া উপজেলার কোর্টবাজারে আন্দোলনকারী শিক্ষক বোরহান উদ্দিন বলেন, দাতাসংস্থা ইউনিসেফের নির্দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো স্থানীয় বাংলাদেশি শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করেছে। স্থানীয়দের বাদ দিয়ে দেশের অন্যান্য বিভাগ ও জেলা থেকে তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, চাকরি ফিরে পেতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারসহ এনজিও সংস্থাগুলোর প্রধানদের কাছে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি, এর আগেও বহুবার আন্দোলন করা হয়েছে। তারা বার বার অর্থ সংকট দেখিয়ে যাচ্ছে। কোনোমতে চাকরি ফিরিয়ে দিচ্ছে না। তাই রাজপথে আন্দোলনে নামতে শিক্ষকদের বাধ্য করা হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন, স্থানীয় শিক্ষকরা সড়কে আন্দোলন করছে শুনেছি বিষয়টি জেলা প্রশাসক বারাবরে অবগত করা হয়েছে। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরিচ্যুত ৪ হাজার শিক্ষকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পভিত্তিক সব শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। কার্যক্রম চালু করতে হলে স্থানীয় শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে প্রকল্প চালু করতে পারবে। অন্যথায় প্রকল্প বন্ধ থাকবে। আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করেছেন উখিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী, উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবুল ফজল, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, জামায়াত সেক্রেটারি সোলতান আহমদ, শিক্ষক শামিম হোসেনসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লার্নিং সেন্টারের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিসেফের বিবৃতি : ইউনিসেফ ১৯৫২ সাল থেকে বাংলাদেশে শিশুদের সহায়তায় নিষ্ঠার সাথে কাজ করে চলেছে; যে কোন অবস্থায় যেন প্রতিটি শিশু মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা পায় সেজন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের জরুরি প্রয়োজনগুলো সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অবগত। এই শিশুদের অনেককে ইতিমধ্যে ব্যাপক মানসিক অভিঘাত সহ্য করতে হয়েছে এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সুরক্ষা ব্যাহত হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই শিশুরা যেন প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং মৌলিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তা নিশ্চিত করা যাতে করে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং যখন তাদের স্বভূমিতে ফেরত যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় আসবে তখন তারা নিজেদের কমিউনিটিতে ভূমিকা রাখতে পারে। দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে বিশ্বে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের তহবিলের যে সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে আমরা কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। এর ফলে এই সময়ে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার জন্য কিন্ডারগার্টেন, গ্রেড ১ ও গ্রেড ২ এ নিয়োজিত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর (হোস্ট কমিউনিটি) ১ হাজার ১৭৯ জন ব্যক্তির সঙ্গে ইউনিসেফের অংশীদারদের থাকা চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে; এই শিক্ষকদের মধ্যে ইংরেজি, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও অংকনের (ড্রয়িং) শিক্ষকেরাও রয়েছেন। ঈদ ও এর পরবর্তী ছুটি (২৯ জুন পর্যন্ত) শেষে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বাকি কর্মীদের শিক্ষা কেন্দ্রে তাদের কার্যক্রমে ফিরে আসাটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে নতুন অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার ওপর। আমাদের চলমান কর্মসূচিগুলোর মূল কাজগুলো চালিয়ে নেবার জন্য, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা শিশুদের জন্য জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য এবং এই অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং সময়ে শিশুদের কল্যাণে আমাদের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখার জন্য এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। আমরা আশাবাদী যে, অতি দ্রুত বাড়তি তহবিল পেয়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো পুনরায় চালু করতে ও আরও বড় পরিসরে চালিয়ে নিতে পারব, যেগুলোর ওপর অনেক শিশু নির্ভর করে আছে। অব্যাহত সহযোগিতার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক কমিউনিটি ও আমাদের অংশীজনদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ইউনিসেফ প্রতিটি শিশুর কল্যাণে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের প্রাপ্য শিক্ষা ও তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সম্পদ যোগাড় করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।