ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ‘বয়কট’ করল জামায়াত

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধিকাংশ বৈঠক ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে, গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ‘বয়কট’ করেছে জামায়াতে ইসলামী।

মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের অসমাপ্ত আলোচনায় বিএনপি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ অন্য রাজনৈতিক দল অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী অংশ নেয়নি। আলোচনায় জামায়াতের অংশ না নেওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সদস্য আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ। ঐকমত্য কমিশনে তিনটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন ও নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একটি সূত্র বলেছে, বৈঠকে জামায়াত থাকবে না-এ বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। কারণ হিসেবে দলটি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে জামায়াতকে ‘ইগনোর’ করা হয়েছে বলে মনে করে দলটি। এর প্রতিবাদ হিসেবে ঐক্যমত্য কমিশনের বৈঠকে যোগ দেয়নি। অবশ্য কমিশনের পক্ষ থেকে দুই ঘণ্টা পরে জামায়াতকে বৈঠকে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয় বলে জানা গেছে।

গতকালের পাশাপাশি ১৮ ও ১৯ জুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের আলোচনায় বসছে কমিশন।

বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদের আসনের পাশের আসনটি জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের জন্য রাখা হয়। তবে তা খালি দেখা যায়। এর পরের আসনটি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি), সেখানে বসেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা। এরপরে বসেন বিএনপির ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আমরা অন প্রোটেস্ট আজকের বৈঠকে যাইনি। বুধবারের বৈঠকে যোগ দেবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা এখনই বলতে পারছি না। আমরা আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। তিনি বলেন, এজন্য আমরা আজকের জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের বৈঠকে যাইনি। কারণ এই কমিশনের প্রধান হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আমরা প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়ে কোনো কথা বলছি না। আমরা বলতে চাই, বৈঠকের পরে যেভাবে একটি দলের কথায় নির্বাচনের তারিখ বদলে দেওয়ার ঘোষণা হল, এটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। জামায়াতের এই নেতা বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, দেশে ফিরে প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে স্পষ্ট করবেন। এদিকে মধ্যাহ্ন বিরতিতে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে বের হওয়ার সময় কয়েকজন সাংবাদিক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দারের কাছে জামায়াতের যোগ না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী প্রতীকী বয়কট করেছে। ‘বয়কটের’ কারণ লন্ডনে ইউনূস-তারেক বৈঠক কি না, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনারা বুঝে নেন।’

সংলাপ থেকে বের হওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জামায়াত কেন আসেনি সেটা তারা বলতে পারবে।’ খাওয়ার বিরতির সময় জাতীয় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরও বলেন, ‘আজকে সংলাপে জামায়েতে ইসলামী অংশ নেয়নি, আমাদের সংলাপে জানানো হয়েছে যে তারা প্রতীকী বয়কট করেছে। আমরাও মনে করি একটি-দুইটি দলকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন, এটা কেন? নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত কিভাবে বলবেন কোন দল কত বড়।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার বিরতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ঐকমত্য কমিশন যাদের আহ্বান করেছে, তারা দেশের শতভাগ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না। যদি এসব রাজনৈতিক দল জন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসতে পারত, তাহলে গণঅভ্যুত্থানের আগে ৫৪ দল মিলে যে আন্দোলন করেছিল, সেটা ফলপ্রসূ হতো। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে তিন ধরনের অংশীজন ছিল উল্লেখ করে আরিফুল ইসলাম বলেন, সব রাজনৈতিক দল মিলে একটি স্টেকহোল্ডার, জনতা আরেকটি স্টেকহোল্ডার এবং সব শিক্ষার্থী মিলে আরেকটি স্টেকহোল্ডার ছিলেন। কিন্তু আলোচনায় শুধু রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু কোনো রাজনৈতিক দলের চেষ্টায় হয়নি উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, এখানে সব পেশাজীবী এবং জনতার অংশগ্রহণ ছিল, যাদের আসলে কোনো প্রতিনিধি নেই। আরিফুল ইসলাম বলেন, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিভিন্ন দলকে কোনো একটি বড় দলের সুপারিশে ডাকা হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে তাঁর দল জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, শুধু একটি দলের বক্তব্যের প্রতি এসব দলের হ্যাঁ অথবা না বোধক সমর্থন থাকে। যখনই বিপরীত কোনো মন্তব্য আসে, তখন সেখানে হট্টগোলের চেষ্টা করা হয়। আলোচনায় জাতীয় সংসদে নারী আসন নির্ধারণের বিষয়ে এনসিপির মতামত তুলে ধরে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই, নারীদের আসন ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হোক। তবে পদ্ধতি এবং সংখ্যা নিয়ে আলোচনা চলমান আছে।’

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এনসিপির অবস্থান তুলে ধরে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পক্ষে ছিলাম। কিন্তু ঐকমত্যের স্বার্থে অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে অন্য বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া যাবে বলে আমরা মত দিয়েছি।’ বুধবার ঐক্যমত্য কমিশনের বৈঠকে জামায়াত যোগ দেবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষে। জুলাই আন্দোলনে যারা অংশীদার, আমরা সবার জন্য সমানভাবে কাজ করছি। আশা করছি আজকে জামায়াত বৈঠকে আসবে।’ গতকালের বৈঠকে অন্যদের মধ্যে যোগ দেন জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস, খেলাফত মজলিসের আহমেদ আবদুল কাদের, গণসংহতি আন্দোলনের আবুল হাসান রুবেল, এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, বিএলডিপির সাহাদাত হোসেন সেলিম, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশ জাসদের মুশতাক হোসেনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা।

উল্লেখ্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। ঈদের আগের (৩ জুন) বৈঠকে তার সঙ্গে ছিলেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আজাদ।