সংসদে নারী আসন ও উচ্চকক্ষ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন ও নারী আসন নিয়ে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উচ্চকক্ষের আসন সংখ্যা ৭৬টি হতে পারে এবং এসব আসনের সদস্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। গতকাল সোমবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৩তম দিনের অধিবেশন এমন প্রস্তাব উত্থাপন করে কমিশন। তবে, কমিশনের নারী আসন ও সংসদের উচ্চকক্ষ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ঐকমত্য হয়নি। ফলে দুটি বিষয়ে আজ মঙ্গলবার ফের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধির সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসবেন। সংসদে উচ্চকক্ষের নতুন প্রস্তাবের বিষয়ে কমিশন বলেছে, প্রতিটি জেলা ও প্রতিটি সিটি করপোরেশন এলাকা উচ্চকক্ষের একেকটি একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকা হিসেবে বিবেচিত/চিহ্নিত হবে এবং প্রত্যেক নির্বাচনি এলাকা থেকে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে একজন করে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। এতে আরও বলা হয়, বর্তমানে দেশে ৬৪টি প্রশাসনিক জেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে বিধায় উচ্চকক্ষের আসনসংখ্যা হবে ৭৬টি। জাতীয় সংসদ (নিম্নকক্ষ) এবং উচ্চকক্ষের নির্বাচন একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ করে যে, বাংলাদেশে নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষের (সিনেট) সমন্বয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি আইনসভা থাকবে। উচ্চকক্ষ আইনি যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাহী ক্ষমতার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে’।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, নারী আসন ও সংসদের উচ্চকক্ষ ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। এ দুটি আজ (মঙ্গলবার) আবারও আলোচনা হবে। ড. আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য স্থায়ীভাবে ১০০ আসন করার ব্যাপারে সব দল একমত হয়েছে। এক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত প্রশ্ন রয়ে গেছে। এর পদ্ধতি নির্ধারণে এখনও একমত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় আসন সংখ্যার সংখ্যানুপাতে ৫০ আসনকে ১০০ আসনে উপনীত করা বা সরাসরি নারী আসনে নির্বাচন- কমিশন প্রদত্ত এই দুই প্রস্তাবে একমত না হওয়ায় বিগত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি হলো- সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ভিন্নভাবে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে যেসব রাজনৈতিক দল ২৫টির বেশি আসনে প্রার্থী দেয় তাদের মধ্যে থেকে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থী নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যাপারেও ঐকমত্য হওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কমিশন থেকে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায়ও কিছু কিছু প্রস্তাব এসেছে, তাই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার আগে গতকাল সকালে ড. আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘চব্বিশের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও জনতার প্রতিরোধের মুখে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। বক্তব্যের শুরুতেই সংগ্রামী জুলাইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ‘চব্বিশের জুলাইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ফ্যাসিবাদবিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৪ জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহ সেটিকে নতুন মোড় দেয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি অবমাননাকর বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরাও মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে আসে। সকলের এই প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিবাদী শাসন ক্রমাগত পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে সম্মান জানিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ১৪ জুলাইকে ‘জুলাই নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
তিরি আরো বলেন, সেদিন নারীদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর অপমানের বিরুদ্ধে হওয়া আন্দোলনকে আরো বেগবান করেছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র বিনির্মাণে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই রাজনীতি, রাষ্ট্র গঠন ও আইন প্রণয়নে নারীদের মর্যাদাপূর্ণ অংশগ্রহণের পথ তৈরি হবে।
এদিকে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর পদ্ধতির পক্ষেই আমাদের অবস্থান। দুটো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কোনোটাই নিষ্পত্তি হয়নি। দুই-তৃতীয়াংশ দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে একমত হয়। উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর পদ্ধতির পক্ষেই আমাদের অবস্থান। তিনি বলেন, নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে আমরা একমত। তবে ভোটের পদ্ধতি হিসেবে আমরা বলেছি, পিআর পদ্ধতিতে এটা বাস্তবায়ন করা যায়। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আরও বলেন, উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে আজ নতুন যে প্রস্তাব (৬৪ জেলা+১২ মহানগর) দিয়েছে কমিশন, এ প্রস্তাব আলোচনার কোনো যোগ্যতাই রাখে না। অর্ধেক আলাচনার পর নতুন প্রস্তাব আনা বিভ্রান্তিকর।
আলোচনায় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ মোট ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।
