গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় মামলা, আসামি ৫০০

প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নিউটন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। জেলার গোপীনাথপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক আহম্মদ আলী বিশ্বাস বাদী হয়ে এ মামলা করেছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দ্বিতীয় দফায় কারফিউর সময় বাড়ানোর পর মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে। তবে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। পরিবেশ শান্ত রয়েছে।

এদিকে কারফিউর কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে নিম্ন-আয়ের মানুষ। একজন অটোচালক বলেন, ‘কারফিউর মধ্যে বাধ্য হয়ে অটো নিয়ে বের হয়েছি। শহরে কোনো যাত্রী নেই। দুই ঘণ্টায় মাত্র ১০ টাকা আয় করেছি। বাড়িতে চাল নেই। অটোভাড়া ৫০০ টাকা দিতে হবে। তারপর যা থাকবে তাই দিয়ে চাল, ডাল ও লবণ কিনে নিয়ে যেতে হবে। বাজার নিয়ে যেতে না পারলে পরিবারের সবাই অনাহারে থাকবে। কারফিউ প্রত্যাহার না হলে কীভাবে বাঁচব বুঝতে পারছি না।’

নিত্যপণ্যের দোকানপাট খোলা ছিল। শহরে সীমিত সংখ্যক রিকশা, ভ্যান ও অটো চলাচল করছে। অভ্যন্তরীণ তিনটি রুটে যানবহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক। লোকজনের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানুষ ঘর থেকে খুবই কম বের হচ্ছে। জেলা শহরসহ সর্বত্র যৌথবাহিনীকে টহল দিতে দেখা যায়।

গোপালগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান বলেন, ৪৫ জনকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে এনসিপির জুলাই পদযাত্রা ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আরেকজন মারা গেছেন। গত বুধবার আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হামলা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সী (৩২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে মারা গেছেন।

গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় এ নিয়ে পাঁচজন মারা গেলেন। এর আগে এ ঘটনায় নিহত হন, গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গিপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ আরও দুজন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা হলেন, সুমন বিশ্বাস (৩০) ও আব্বাস আলী (৩০)। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, রমজান আলী মুন্সীর বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর থানাপাড়ায়। তিনি মৃত আকবর মুন্সীর ছেলে। রমজান আলী রিকশাচালক ছিলেন। আহত অবস্থায় রমজান মুন্সীকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন তার ভাই হীরা মুন্সী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার ভাই রিকশাচালক। ঘটনার দিন গত বুধবার দুপুরে গোপালগঞ্জ সদর এলাকায় সিনেমা হলের পাশেই রিকশা থেকে যাত্রী নামিয়ে ফেরার পথে তিনি সহিংসতার মধ্যে পড়েন এবং গুলিবিদ্ধ হন। তাকে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং পরে অবস্থার অবনতি হলে ওই দিনই দিবাগত রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ আলম বলেন, রমজান মুন্সীর লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রাখা হয়েছে। গত বুধবার দিনভর দফায় দফায় গোপালগঞ্জে হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ১ জুলাই থেকে সারা দেশে মাসব্যাপী জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল গোপালগঞ্জে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ ঘোষণা করেছিল এনসিপি। এই কর্মসূচি ঘিরে সকাল ৯টার পর থেকে বিকেল পর্যন্ত চার দফায় হামলা চালান কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সদর উপজেলার কংশুরে পুলিশ সদস্য ও তাদের গাড়ি, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), শহরের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশস্থল, জেলা প্রশাসকের বাসভবন ও জেলা কারাগার চত্বরসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনাগুলো ঘটে। এ সময় বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়।

উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বেলা ২টা ৫ মিনিটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। এর আগে সমাবেশস্থলে মঞ্চ ভাঙচুর ও হামলা চালান আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে সমাবেশ শেষে বেলা পৌনে ৩টার দিকে ফেরার সময় হামলার শিকার হন এনসিপির নেতারা।

বিকেল ৫টার দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সহায়তায় গোপালগঞ্জ ত্যাগ করে এনসিপির নেতারা। গত বুধবার রাত আটটা থেকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জ জেলায় কারফিউ জারি করা হয়। পরে কারফিউয়ের সময় গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তিন ঘণ্টা শিথিল করে দুইটা থেকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত কারফিউয়ের সময় বাড়ানো হয়েছে।

কারফিউয়ের মধ্যে অভিযানে আটক ৪৫ : গোপালগঞ্জে সংঘর্ষ, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মো. সাজেদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওসি সাজেদুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় সদর থানায় এখন পর্যন্ত ৪৫ জন আটক আছেন। তাদের থানায় রাখা হয়েছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত যৌথবাহিনীর অভিযানে ২৫ জনকে আটক করা হয়েছিল। অন্য ২০ জনকে গতকাল রাতে যৌথ বাহিনী গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে থানায় হস্তান্তর করেছে। আটকের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও আদালতে না তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, এ বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতে তোলা হবে। পাঁচজন নিহত ও সংঘর্ষের ঘটনায় এখনো মামলা না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গোপালগঞ্জে কারফিউয়ের সময় আরও বাড়ল : এনসিপির সমাবেশ ঘিরে হামলা, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনার পর জারি করা কারফিউ আজ শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গতকাল শুক্রবার গোপালগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটে মুহম্মদ কামরুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এর আগে, গত বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। পরে সংঘর্ষ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। তবে পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউর সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে।