জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত
প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়, দলগুলো একমত
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বহুল কাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। গতকাল রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৯তম বৈঠকের শুরুতে এ বক্তব্য দেন ড. আলী রীয়াজ। আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন ইতোমধ্যে একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে এবং বিবেচনার জন্য আজ সোমবার সব রাজনৈতিক দলের কাছে একটি করে খসড়া প্রেরণ করা হবে। সেটি নিয়ে আপনারা নিজেদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার মাধ্যমে আমাদেরকে মতামত জানালে সেগুলো এতে সন্নিবেশিত করা হবে। এসময় তিনি জানান যে, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বড় ধরনের কোনো মৌলিক আপত্তির বিষয় উত্থাপিত না হলে সেটি নিয়ে বৈঠকে আর আলোচনা করা হবে না। তিনি জানান, সবার মতামত পাওয়ার পর সেগুলোকে সন্নিবেশিত করে চূড়ান্ত জুলাই সনদের পটভূমি, প্রাথমিক বক্তব্য সমূহ, অঙ্গীকার এবং প্রক্রিয়ার বিষয় বস্তুগুলো অন্তর্ভুক্ত করে তা রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে তুলে ধরা হবে। সময়ের স্বল্পতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি সবাইকে বলেন, ‘আমাদের আলোচনা যেকোনোভাবে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। আলোচনা শেষ করার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শেষ করার পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হতে চাই। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি, ১০টি বিষয়ে আমরা একধরনের ঐকমত্যে পৌঁছেছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট আছে এবং সাতটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু তা অসমাপ্ত রয়েছে এবং তিনটি বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় সনদে সই করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করতে চাই, যেন প্রক্রিয়াটাকে নিয়ে সমাপ্তির দিকে অগ্রসর হতে পারি।’
প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১৯তম দিনের মধ্যাহ্ন বিরতিতে কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর করার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। একই সঙ্গে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনেও দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
আলী রীয়াজ বলেন, আমরা একটা বিষয়ে একমত হয়েছিলাম, কিন্তু সেটা বলা হয়নি। সেটা হল- একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদকালের জন্য দায়িত্বপালন করবেন। সনদে প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির মেয়াদকাল ১০ বছর উল্লেখ করবো। এ বিষয়ে আমরা কি একমত হয়েছি? এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ সাহেব একটি শর্ত দিয়েছিলেন, সেটা কি এখনো আছে? তার পরে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, আমরা একবার বলেছিতো বলেছি, ১০ বছরের বেশি কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন না। আমি বলেছিলাম সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের কমিটি থাকলে বিষয়টি মানব না। আমরা এ হাউজের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত করবো। এর বাইরের বিষয়ে আলোচনা হলে আমাদের শর্ত বহাল থাকবে। আশা করি, সেটা বিবেচনা করবেন। এখন ১০ বছরের বিষয়ে আপনারা ঘোষণা দিতে পারেন। বরং এটা আমাদের প্রস্তাব।
স্বাধীন পুলিশ কমিশন: বাংলাদেশ পুলিশের পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উপস্থাপন করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পরে দলগুলো আলোচনা করে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে একমত হয়। তবে এর আইনি কাঠামো নিয়ে আলোচনা হবে। এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, পুলিশ কমিশনের বিষয়ে আমরা একমত। গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা আলোচনা করব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনায় একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে একমত হয়েছে। যা পুলিশের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবে, জনবান্ধবতা নিশ্চিত করবে। পুলিশ কমিশন বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়, পুলিশ বাহিনী যেন একটি শৃঙ্খলিত বাহিনী হিসেবে আইনসম্মত ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে, তা নিশ্চিত করা হবে কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে পুলিশ সদস্য ও সাধারণ নাগরিক উভয় পক্ষের অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্বও এই কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে। প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশ কমিশন (যা ‘কমিশন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে) গঠিত হবে একজন অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারপতির নেতৃত্বে, যার বয়স হতে হবে ৭২ বছরের নিচে। কমিশনের সদস্য সচিব হবেন অবসরপ্রাপ্ত একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল আইজিপি) পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা, যার বয়স ৬২ বছরের নিচে হবে। এ ছাড়া কমিশনে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এদের মধ্যে থাকবেন সংসদে সরকার দলের নেতা (লিডার অব দ্য হাউস), বিরোধী দল নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের (যিনি বিরোধী দল থেকে হবেন) একজন করে প্রতিনিধি। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী, যিনি হাইকোর্ট বিভাগে অন্তর্ভুক্ত এবং কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন; একজন মানবাধিকার কর্মী, যিনি কমপক্ষে ১০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা সদস্য হিসেবে থাকবেন।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কমিশনের অন্তত দুইজন সদস্য নারী হতে হবে। কিছু নির্ধারিত সদস্য বাছাইয়ের জন্য একটি বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে, যার সদস্য থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক। কমিশনের চেয়ারপারসন ও সদস্য সচিব পূর্ণকালীন দায়িত্ব পালন করবেন, বাকি সাতজন সদস্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বৈঠকে উপস্থিতি ও অন্যান্য দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী সম্মানী বা ভাতা গ্রহণ করতে পারবেন। কমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্য সচিব ও অন্যান্য সদস্যদের দায়িত্ব, ক্ষমতা, জবাবদিহিতা, পদত্যাগ এবং অপসারণের পদ্ধতি একটি আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কমিশনের নীতিগত ও নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তা অনুমোদিত হবে। এদিন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত মূলনীতি ও পুলিশ কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছবে সেগুলো নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করা হবে। এর মধ্যে জাতীয় সনদের প্রাথমিক খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতে সোমবার পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি। আলী রীয়াজ বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করা। সনদের প্রাথমিক খসড়া কমিশন তৈরি করেছে। আগামীকালের মধ্যে সে খসড়া দলগুলোকে পাঠানো হবে। আমরা মনে করি মতামত দিলে সেটা সন্নিবেশিত করা হবে।
খসড়া নিয়ে সংলাপে আলোচনা করা হবে না জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, যদি বড় রকমের মৌলিক আপত্তি ওঠে, তাহলে আলোচনায় আনব, না হলে আনব না। আপনাদের পক্ষ থেকে মতামত দেওয়া হলে তা সন্নিবেশিত করে প্রাথমিক সনদে.. সেখানে ভূমিকা পটভূমি থাকবে এবং কমিটমেন্টের জায়গা থাকবে। জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের জন্য সংলাপে একটি দিন বরাদ্দ করা হবে বলে জানান আলী রীয়াজ। সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। দলগুলোর মধ্যে ৩৩টি তাদের মতামত দিয়েছে। এরপর ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ করে ঐকমত্য কমিশন। কোরবানির ঈদের আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়। এরপর ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করে কমিশন, যা এখনো চলছে। এই আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা যুক্ত করে জাতীয় সনদ তৈরি হবে, রাজনৈতিক দলগেুলো তাতে স্বাক্ষর করবে। এর অর্থ হল, জাতীয় সনদে যেসব সংস্কারের কথা লেখা থাকবে, সেসব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগামীতে যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, সনদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা সেভাবে সংস্কার এগিয়ে নেবে। উল্লেখ্য, গতকালের বৈঠকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের প্রস্তাব, পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনা হয়।
