হৃদয়ে রক্তক্ষরণ
বাবাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলো না শহিদ মামুনের
জুলাই ২০২৪
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাসস

‘বাড়ি ভর্তি কত মানুষ। কেউরে চিনি আবার কেউরে চিনি না। অনেকে নফল নামাজ পড়তে কয়। আমি কি বুঝছি আমার পোলায় মরছে, আমার পোলায় রক্ত না পাইয়া ফুরাইয়া গেছে- হের লাইগ্যা নামাজ পড়তে কয়! আমার সব স্বপন তো শেষ হইয়া গেল গা। আমি আর বাঁইচ্যা থাইকা কী করুম!’
বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রামপুরা উলন ওয়াপদা রোড এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ মামুন মিয়ার (২৫) মা হেনা বেগম। মামুনের গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুর সদরের শৌলপাড়া থানার পূর্ব চিকন্দী গ্রামে। তার বাবা গণি মাতবর একসময় কৃষিকাজ করতেন। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। মা হেনা বেগম গৃহিণী। মামুন তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি পারিবারিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পশ্চিম রামপুরার ওমর আলী রোডে একটি ভবনে প্রায় ৫-৬ বছর ধরে একটি অনলাইন প্রডাক্ট বিক্রির প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।
মামুনের মা হেনা বেগম বলেন, ‘ছেলে ঢাকায় থাকলেও প্রতিদিন কয়েকবার মোবাইলে কথা বলত। মারা যাওয়ার দিন সন্ধ্যায় মোবাইলে কল দিয়ে বলে, ওর অসুস্থ বাপরে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। শরিয়তপুরের একটা ক্লিনিকে সিরিয়াল দিয়া রাখছে। ওয় রাইতে ঢাকা থন আইব, হের পরদিন ডাক্তার দেহাইয়া ঢাকায় আবার ফেরত যাইব। মামুন এও কইল, মা, ঢাকায় গ-গোল হইতেছে, পুলিশ অর্ডার দিছে রোডে বাইর হওন যাইব না।’
তিনি বলেন, ‘আমি হুইন্যা কইলাম, বাবারে ভুলেও রাইতে বাইর অইস না। হাগা-মুতা যাই ধরুক ঘরের ভিতরে করবা বাবা, বাইর হইও না। এরপর সারারাইত পোলায় আর মোবাইল করে নাই। ক্যান জানি রাইতভর দাপটাইলাম। ভোরের দিকে উইঠ্যা সংসারের কামকাইজ করতাছি, এমুন সময় পাশের বাড়ির জব্বার ভূঁইয়ার পোলা আবুল আইয়া কয় কি, মামুনের কোনো খবর আছে? হেরে কল দ্যান।’
হেনা বেগম বলেন, ‘আমি মোবাইলে কল দিতাছি, আমার বাপে ধরে না। একবার মামুনের ফোন ধরলো একজন, হেয় কইল, মামুনের মাথার পিছন দিয়া গুলি করছে, গুলি সামনের দিক দিয়া বাইর অইয়া গেছে। আমার সাইজ্যা পোলা রুবেলরে কল দেই, হুনি মামুনের শরীরে গুলি লাগনের পর ওরে নিয়া হাসপাতালে গেছে, রক্তের দরকার। ওরায় দৌড়াদৌড়ি করতাছে তহনও বুঝি নাই আমার বাপেরে হারায় ফেলছি।’
তিনি আরও বলেন, আমার পোলা রুবেল খবর পাইয়া গাজীপুর থাইক্যা হাসপাতালে যাইয়া দেহে মামুনরে অক্সিজেন দিয়া রাখছে। অনেক কষ্টে রক্ত জোগার কইরা দিতেও পারে নাই ঠিকমতো। রক্তের অভাবে পোলাডা মইরা গেছে। ওর লাশ বাড়িতে আনতেও সমস্যা অইছে। পুলিশ গাড়ি আটকায়া দিছে। লাশ আইন্যা বাজার খোলা মসজিদ স্কুলের মাঠে জানাজা পড়ান অইছে। পরে ঘরের দুয়ারে মাটি দেওয়া অইছে।’
মামুনের ভাই রুবেল মিয়া বলেন, ‘খবর পেয়ে গিয়ে দেখি মামুন হাসপাতালের বেডে পইড়া আছে। অক্সিজেন দেওয়া। জীবনে এমন দৃশ্য শুধু সিনেমায়-নাটকে দেখছি। ভাবছি, ভাই একটু পর চোখ খুলবে। ও যে মারা যাবে তা জীবনেও ভাবি নাই। মামুনের মাথার বামদিকে গুলি লাগছিল। ওই জায়গায় অপারেশন হয়। ডাক্তার আশা দিয়েছিল। ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল বাঁচার, কিন্তু তা আর হয়নি।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিতে আহত মামুনের সহকর্মী আতিকুর রহমান (২৬) বলেন, একটা অনলাইন প্রোডাক্ট সেলিং কোম্পানিতে আমরা ১৫ জন কাজ করতাম। কর্মস্থলের অন্যরুমগুলোয় আমরা একসঙ্গে মেসের মতো করে থাকতাম। এ প্রতিষ্ঠানে মামুনভাই চার-পাঁচবছর ধরে কাজ করত।’
আতিকুর রহমান বলেন, ‘১৯ জুলাই দিবাগত রাত আনুমানিক দুইটার দিকে এলাকায় লোডশেডিং হয়। অফিসের কাজ স্থগিত হয়, কম্পিউটার অফলাইন হয়ে যায়। সবাই গরম থেকে বাঁচতে হাঁটতে হাঁটতে সামনে রাস্তার দিকে এগোই। এমন সময় হঠাৎ পুলিশের গাড়ি থেকে অতর্কিতে গুলি ছোড়া হয়। এসময়ই মামুন ভাইয়ের মাথায় গুলি লাগে।’ ‘ঘটনার পর মূল সড়ক থেকে দৌড়ে আমরা ফ্ল্যাটের কাছে চলে আসি। প্রথমে বুঝি নাই যে আমাদের শরীরে গুলি লেগেছে। মামুন ভাই মাথায় হাত দিয়ে টের পায়, তার গুলি লেগেছ। দ্রুত আমরা তাকে বেটার আইফ হামপাতালে নিয়ে যাই।’ ‘ওখান থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিতে বললে রাস্তায় পুলিশের বাধার মুখে যেতে পারি নাই। পরে মুগদা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকেও ফিরিয়ে দিলে আগারগাঁও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্রুত আইসিইউতে নিয়ে অপারেশন করা হয়।’ ‘কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে মামুনভাইকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তার ছোট ভাইসহ আমরা রক্ত জোগাড় করে সাধ্যমতো বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। ভাই অপারেশনের পর বেশিক্ষণ বাঁচে নাই।’
মামুনের ভাই রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমরা কৃষক পরিবারের সন্তান। আমরা অভাবের কারণে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারি নাই। মা-বাবার ছোট ছেলে মামুনই ছিল পরিবারের একমাত্র আশা-ভরসার স্থল। মেধাবী মামুনের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। ২২ আগস্ট আমেরিকায় যাওয়ার ভিসাও তৈরি হয়েছিল। তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের ছাত্র ছিল সে। আমাদের পরিবার তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল।’ রামপুরা ডিআইটি রোডের বেসরকারি বেটার লাইফ হাসপাতালের সিইও ডা. মো. মনসুর আলী বাসসকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের যথাযথ সেবা দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল।
তিনি জানান, বেটার লাইফে আহত রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদেরকে মুগদা ও ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশের গুলি খেয়ে মৃত্যু হয়েছে, এমন কয়েকজনকে ব্রট ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু ডেডবডি, ৫-৬ টা হবে, পোস্টমর্টেম না করেই অভিভাবকরা হাসপাতাল থেকে রিসিভ করে নিয়ে গেছেন। তিনি জানা, প্রাথমিক অবস্থায় যখন সারা দেশে গ-গোল শুরু হয়, তখন ছাত্ররা চিকিৎসার জন্য আসছিল। সেসময় পুলিশ এসে ছাত্রদের চিকিৎসাসেবা দিতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিল বলে জানান তিনি। এ হাসপাতাল থেকে চারজনকে ব্রট ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক ছাত্র আহত পুলিশ সদস্যদেরও এখানে নিয়ে এসেছে। গানশট ইনজুরি ও বুলেট ইনজুরির প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমরা বিনামূল্যে স্যালাইন, ইনজেকশন, ব্যান্ডেজ ও ওষুধপত্র সরবারহ করেছি।
