এনসিপির ইশতেহারে নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক
* ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে চাই : নাহিদ * নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার হবে পথপ্রদর্শক : আখতার * মুজিববাদী সংবিধান আর রাখতে চাই না : সারজিস আলম * রাজনৈতিকভাবে জবাব দেব : হাসনাত আবদুল্লাহ
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় নাগরিক পার্টি ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। এনসিপির ঘোষিত ইশতেহার নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আমরা আবার শহীদ মিনারে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে একটি নতুন বাংলাদেশের, আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকের ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করছি। গতকাল রোববার বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে তিনি এ ইশতেহার ঘোষণা করেন। এসময় বলা হয়, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে সংঘটিত সব মানবতাবিরোধী অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করবে এনসিপি। একই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করে আজীবন তাদের পাশে দাঁড়াবে দলটি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতনের ডাক দিয়েছিলাম। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাজিত করে এক অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করেছিলাম। আমাদের সুস্পষ্ট এক দফা দাবি ছিল, আমরা ফ্যাসিবাদী ব্যাবস্থার বিলোপ করে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে চাই। কেবল এক ফ্যাসিবাদী শাসক হঠিয়ে আরেক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্থানের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রেখে আমরা নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরতে পারিনি। বরং রাষ্ট্র ও সমাজে দীর্ঘদিনের জেঁকে বসা এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটনে আপনাদের তীব্র আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আমরা আপনাদের, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি গঠন করেছি।
তিনি বলেন, গত এক বছরে আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, রাষ্ট্রের মৌলিক ও কাঠামোগত সংস্কারে বিভিন্ন শক্তিশালী পক্ষের বিরোধিতার মুখেও এনসিপি আপনাদের পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের জন্যে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এই মৌলিক সংস্কারগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন ছাড়া ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভেঙে ফেলে আমাদের ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তরিত হবে না।
এনসিপির আহ্বায়ক দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বঙ্গীয় বদ্বীপের জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা এক সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার নিপীড়িত কৃষক ও গণমানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। কিন্তু শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ আরও ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আশায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
‘কিন্তু ১৯৭২ সালের মুজিববাদী সংবিধান ও তৎপরবর্তী বাকশালি অপশাসন, দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ ছিলো মানুষের এই সুদীর্ঘ ত্যাগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি নিষ্ঠুর প্রতারণা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো একটি একমুখী ও স্বেচ্ছাচারী মতবাদ। তারপর রাষ্ট্র গঠনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরোলেও স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও এমন একটি রাষ্ট্র তৈরি করাত পারিনি যা গণদের, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। বরং দেশে একটিট নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপুল গণবিস্ফোরণ ছিলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত এই অপশাসনের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের গণরায়। আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই নতুন স্বাধীনতা কেবল সরকার পরিবর্তনের জন্যই ঘটেনি। যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ কয়েম হয়, আমরা সে ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলাম।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ফ্যাসিবাদ পতনের বছরপূর্তিতে এই জুলাইয়ে আমরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, জাফলং থেকে সুন্দরবন, বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা; আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা; চায়ের টঙের দোকান থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চা শ্রমিক আপনাদের সবার ভালবাসায় সিক্ত হয়েছি। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে, আমাদের শহীদ পরিবার আর আহত ভাই-বোনদের প্রত্যাশার কথা শুনেছি। শুনেছি আপনাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা, এবং স্বপ্নের কথা।
তিনি বলেন, আমাদের দলের জন্ম, এনসিপির জন্ম, আমাদের সকল শ্রম, আপনাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। আপনাদের অভিযোগ-অনুযোগ, প্রত্যাশা আমাদের ভাবনাকে করেছে গভীর, আমাদের লক্ষ্যকে করেছে সমৃদ্ধ। তাই ঠিক একবছর পরআমরা আবার শহীদ মিনারে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, একটি নতুন বাংলাদেশের, আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকের ২৪ দফা ইশতিহার ঘোষণা করছি।
এর আগে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, নতুন বাংলাদেশের যে ইশতেহার ঘোষিত হবে, সেই ইশতেহার হবে আমাদের পথপ্রদর্শক। সেই ইশতেহার অনুসরণ করে প্রতিটা সংকট ও সমাধানের পথ আমরা খুঁজে নেব।
তিনি আরও বলেন, এনসিপি বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষকে, সব জাতিসত্তাকে, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। নতুন বাংলাদেশের যে বার্তা আমরা দিতে চাই, সেটি দৃঢ প্রতিজ্ঞ থেকে আমরা বাস্তবায়ন করে যাব ইনশাআল্লাহ।
নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার ঘোষণার জন্য আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশের আয়োজন করেছে এনসিপি।
ইশতেহারগুলো হলো- ১। নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক, ২। জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার, ৩। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, ৪। ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কার, ৫। সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন, ৬। জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ৭। গ্রাম পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকার, ৮। স্বাধীন গণমাধ্যম ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, ৯। সার্বজনীন স্বাস্থ্য, ১০। জাতিগঠনে শিক্ষানীতি, ১১। গবেষণা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব,১২। ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিসত্বার মর্যাদা, ১৩। নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন , ১৪। মানবকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি, ১৫। তারুণ্য ও কর্মসংস্থান, ১৬। বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নীতি, ১৭। টেকসই কৃষি ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব, ১৮। শ্রমিক-কৃষকের অধিকার, ১৯। জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ২০। নগরায়ন, পরিবহন ও আবাসন পরিকল্পনা, ২১। জলবায়ু সহনশীলতা ও নদী-সমুদ্র রক্ষা, ২২। প্রবাসী বাংলাদেশির মর্যাদা ও অধিকার, ২৩। বাংলাদেশপন্থী পররাষ্ট্রনীতি, ২৪। জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, জুলাই বিপ্লবের এক বছর পেরিয়ে এসেছি। এ এক বছর আমরা শুধু কথা বলে গেছি, এখন সময় কাজের।
তিনি বলেন, মনে রাখবেন, এখন থেকে রূপসা থেকে পাথরিয়া- এনসিপির কোনো কর্মীর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও আমরা রাজনৈতিকভাবে তার জবাব দেবো। কোনো হুমকি-ধমকিতে আমরা পিছিয়ে যাবো না।রোববার (৩ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণার সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব দিকনির্দেশনা দেবেন, আমরা তা বাস্তবায়ন করবো। প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকবো।
তিনি বলেন, আমরা জানি এলাকায় এলাকায় এনসিপির কর্মীদের ভয় দেখানো হচ্ছে, বাধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখবেন, এখন থেকে রূপসা থেকে পাথরিয়া- এনসিপির কোনো কর্মীর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও আমরা রাজনৈতিকভাবে তার জবাব দেবো। কোনো হুমকি-ধমকিতে আমরা পিছিয়ে যাবো না।
হাসনাত আবদুল্লাহ আরও বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি, ভয় পাবেন না। এনসিপির আন্দোলন আর আদর্শ কেউ থামাতে পারবে না। আমাদের স্বপ্ন ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক একটি রাষ্ট্র। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো।
সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাহাত্তরের সংবিধান একটা দলের ছিল। যে সংবিধান আরেকটা দেশ থেকে পাস হয়ে এসেছে। এই মুজিববাদী সংবিধান আর বাংলাদেশে থাকতে দিতে পারি না। আমরা আজ এই মঞ্চে মুজিববাদী সংবিধান ভেঙে চুরে শেষ করে দিয়ে নতুন সংবিধান চাইতে এসেছি।
তিনি বলেন, ২৩ বছরে পাকিস্তান শাসনে ছিলাম, অধিকার পাইনি। ৫৪ বছরেও দেশেও অধিকার পাইনি। আজ থেকে এক বছর আগে আমরা এই শহীদ মিনার ছিলাম। এদিন হাসিনার পতনের ডাক এসেছিল। এক বছর হয়ে গেছে আজও আমাদের অধিকার পাইনি। আমরা আর হতাশার কথা শুনতে চাই না।
সারজিস আলম বলেন, এক বছর আগে এই শহীদ মিনারে যারা ছিল, তাদের অনেকে আজ শহীদ। তাদের পরিবার এখানে আছে। আমরা এই শহীদ ভাইদের হত্যার বিচার চাইতে এসেছি। আমরা এই সরকারের কাছে মৌলিক সংস্কারের নিশ্চয়তা চেয়েছি। শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহত যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এখানে এসেছি।
এনসিপির এই নেতা বলেন, আমাদের লড়াই ২৪ এর নয়। বিডিআর হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, ১৩ সালে শাপলা চত্বরে যারা নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিচার চাইতে এসেছি। এই বাংলাদেশে যেমন জঙ্গিবাদ মেনে নেব না, তেমনি জঙ্গি নাটকও মেনে নেব না। এই বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি নামে সব দালালকে আর মেনে নেব না।
