শোক ও গৌরবের জুলাই

দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত, নিহত ১০১

৩৫ জুলাই ২০২৪

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৪ আগস্টে (৩৫ জুলাই) দেশজুড়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, গুলি, হামলা ও পাল্টা হামলায় ১০১ জন নিহত হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন এলাকার ৯১ জন। আর ঢাকায় প্রাণ গেছে ১০ জনের। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছিল তিন সহস্রাধিক। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, এক সাংবাদিকসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ছিলেন।

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়ে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। এদিন শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে সারাদেশে কমপক্ষে ১০১ জন নিহত হন। শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়।

সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দিনভর আওয়ামী লীগ সমর্থক ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া হাসপাতাল, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা, থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই দিন রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, কারফিউ ভাঙলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ এবং সারাদেশের নিম্ন আদালত বন্ধ ঘোষণা করে কোর্ট প্রশাসন। দেশের সব তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় বিজিএমইএ।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে সোমবার করার ঘোষণা দেয়। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, শাহবাগ, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ছিল উত্তাল। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারদলীয় নেতাকর্মীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও আন্দোলনকারীর মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংঘাত হয়। রাজধানীর রামপুরাসহ কয়েকটি এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেটে জড়ো হয়। এসব এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নেয় আড়াই শতাধিক। তাদের অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ। বিক্ষোভকারীর একটি অংশ শাহবাগ থেকে দুপুরের দিকে বাংলামটরের দিকে যাত্রা করে। এ সময় রামপুরা থেকে মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা বাংলামটরে যুক্ত হয়। পরে একযোগে তারা কারওয়ান বাজার হয়ে বিকেল ৩টায় ফার্মগেটে পৌঁছায়। এরপর সেখানে আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। এতে ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারে অন্তত দু’জন নিহত এবং পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। রাজধানীর শাহবাগে বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ গৃহযুদ্ধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের দলীয় ক্যাডারদের রাস্তায় নামিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক- বিজয় ছাড়া কিছু নয়। আমরা এখনো সময় দিচ্ছি। সরকার যদি সহিংসতা চালিয়ে যেতে থাকে, আমরা জানিয়ে দিতে চাই, আমরা গণভবনের দিকে তাকিয়ে আছি।’ নাহিদ ইসলাম বলেন, যদি আমার ভাইদের বুকে গুলি করা হয়, যদি আমার বোনেরা আর আহত হয়, তাহলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। যেখানেই আঘাত আসবে, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ঢাকার বাইরে নিহতদের মধ্যে সিরাজগঞ্জে ২২, লক্ষ্মীপুরে ১১, ফেনীতে ৮, নরসিংদীতে ৬ আওয়ামী লীগ নেতা, সিলেটে ৬, কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের তিনজনসহ ৫, রংপুরে ৫, মাগুরায় ৪, বগুড়ায় ৩, মুন্সীগঞ্জে ৩, পাবনায় ৩, কুমিল্লায় পুলিশসহ ৩, শেরপুরে ৩, জয়পুরহাটে ২, বরিশালে এক আওয়ামী লীগ নেতা, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, টাঙ্গাইলে ও হবিগঞ্জে একজন। ঢাকার পাশের কেরানীগঞ্জে এক আওয়ামী লীগ নেতা, সাভারের আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে একজন করে নিহত হয়।

উত্তরায় বিক্ষোভে গুলি : রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলনকারীর বিক্ষোভে গুলি চালায় অস্ত্রধারীরা। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও অন্যান্য পেশার লোকজন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন।

যাত্রাবাড়ী রণক্ষেত্রে পরিণত হয় : রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে অবস্থান করা দুই শতাধিক আওয়ামী লীগ অনুসারীকে মুহূর্তেই ধাওয়া দিয়ে অলিগলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের বসে থাকা চেয়ারগুলো গুঁড়িয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। পরে পুরো চৌরাস্তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে তারা। অথচ এর আগে সকাল থেকেই চেয়ার পেতে বসে ছিলেন আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও অনুসারীরা লাঠি নিয়ে মাঝেমধ্যেই মিছিল করছিল। ওই দিন সকাল থেকে হানিফ ফ্লাইওভারের পূর্বপ্রান্ত থেকে সাইনবোর্ড এলাকা ছিল সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে। সড়কে যান চলাচল ছিল বন্ধ। সকাল ১০টার দিকে বিক্ষোভকারীরা যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার কাছাকাছি পৌঁছালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের সরিয়ে দেয়। সরকারবিরোধীরা ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার কাছে থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছড়িয়ে পড়েন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাজলা ফুট ওভারব্রিজের পাশে একটি গলি থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সরকার সমর্থকরা গুলি ছুড়লে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। আধা ঘণ্টা ধরে চলে এ অবস্থা। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। দুপুর ১টার দিকে টোলঘর প্রান্ত থেকে শত শত বিক্ষোভকারী যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা অভিমুখে এগোতে থাকে। এ সময় সরকারি দলের অনুসারীরাও লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরে রাস্তার মাঝে ফ্লাইওভারের নিচে থাকা পুলিশ সদস্যরা সরে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে অবস্থান নেন। বিক্ষোভকারীরা থানার সামনে পৌঁছালে পুলিশের পক্ষ থেকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো হয়। এরপর সরকারি দলের অনুসারীদের ধাওয়া দিলে তারা আশপাশের অলিগলিতে ঢুকে যায়। সরকারি দলের অনুসারীরা কয়েকবার অলিগলি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও বিকেল পর্যন্ত আন্দোলনকারীরাই চৌরাস্তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে।

রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডার পরিস্থিতি : সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আফতাবনগরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করেন। এর এক ঘণ্টার মধ্যে খণ্ড খণ্ড মিছিলে আরও আন্দোলনাকারী যুক্ত হন সেখানে। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আফতাবনগরের জহুরুল ইসলাম সিটির গেটে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে বিক্ষোভ করেন। এর পর তারা প্রগতি সরণিতে এসে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন। মেরুল বাড্ডা থেকে রামপুরা উলন পর্যন্ত রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। সকাল থেকেই ওই সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকেই ওই এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি। অবশ্য বিটিভি ভবনের গেটে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়েন ছিল। এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দুপুর আড়াইটার পর আন্দোলনকারীদের একাংশ মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে রওনা হয়। সরেজমিন দেখা যায়, উত্তাল ঢাকার মাঝে এক টুকরো রংতুলির ক্যানভাস যেন রামপুরা বনশ্রীর সি ব্লক। পিচঢালা কালো রাস্তা বিভিন্ন প্রতিবাদী লিখনচিত্রে পরিপূর্ণ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এই লিখনচিত্র ও গ্রাফিতি করায় অংশ নেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ আশপাশের মানুষ স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকজন অভিভাবককে শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার বিতরণ করতে দেখা যায়।