ভোটের সময় ঘোষণাকে স্বাগত বিএনপির, অন্যদের ভিন্ন সুর

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা সামনে রেখে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন নিয়ে গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ভাষণের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। নির্দিষ্ট করে নির্বাচনের ঘোষণাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি না থাকলেও আগে জুলাই সনদদের আইনিভিত্তি ও নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কথা বলেছে। যদিও জাতীয় নির্বাচনের এই ঘোষণা নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। তবে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে সময় ঘোষণা করেছেন, সেখানে বিএনপির চাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ও সাংবিধানিকভিত্তি এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি। এটি নিশ্চিত করেই নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া বলেছেন, ‘বিএনপি মনে করে, এই ঐতিহাসিক ঘোষণায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে যাবে, গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সুগম করবে। বিএনপি আশা করছে, এই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একটি কার্যকরী জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য বিএনপি সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।’ এই নির্বাচন অতি জরুরি বলে উল্লেখ করেন বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এখন এই নির্বাচনটা দেশের জনগণই চায়। জনগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে বড় প্রহরী হয়ে দাঁড়াবে।’

গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের পরে রাতে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি ?যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পরে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির মহাসচিব। তার সঙ্গে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

বুধবার রাজধানীর মগবাজারের আল ফালাহ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে আগামীর সংসদ নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণাকে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের দাবির বাস্তবায়ন বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের হওয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই। তবে তার আগে জুলাই সনদদের আইনিভিত্তি ও নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। সরকার চাইলে এই দাবিগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করে জামায়াত।’

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির (পিআর) দাবি জানিয়ে আসছে জামায়াত। পিআর পদ্ধতি ছাড়া জামায়াত নির্বাচন অংশগ্রহণ করবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এটি আমাদের দাবি। আমরা আমাদের দাবির ব্যাপারে আন্দোলন করব। পরবর্তী সময়ে কী হয়, সেটি দেখার বিষয়।’

জামায়াতের এই নায়েবে আমির বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন। তা না করায় জাতি হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার দীর্ঘদিনের যে ঐতিহ্য, তা উপেক্ষা করে জুলাই ঘোষণার দিনেই নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে। তথাপি জাতীয় স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।’

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন দ্রুতসম্পন্ন করে অধ্যাদেশ, এলএফও বা গণভোটের মাধ্যমে আইনিভিত্তি প্রদান করা না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বিফলে যাবে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতের এই নেতা। তিনি বলেন, তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী ও সংস্থার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনকে স্বৈরাচারের দোসরমুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সব স্তরে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর বাংলা মটরে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জুলাই ঘোষণাপত্র ও প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছেন। নির্বাচন আয়োজনের আগে সরকারের অবশ্য পালনীয় কিছু কর্তব্য রয়েছে। গণহত্যাকারীদের বিচার, রাষ্ট্রকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংস্কারের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। তাই নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারকে দৃশ্যমান করতে হবে।’

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন এটাকে স্বাগত জানাই। এখন নির্বাচন কমিশন কী করে, সেটা তারা কথা বলবেন। তারা সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা করবেন। তবে সেটা ডিসেম্বরের আগে বলে মনে হয় না।’

বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদকের ভাষ্য তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন বিষয়ে রাজনৈতিক নির্দেশনার প্রয়োজন ছিল। এখন প্রধান উপদেষ্টার চিঠি গেলে ইসি আশ্বস্ত হবে। তারা বিস্তারিত সূচি সেটা দেবে। ধারণা করি, ডিসেম্বরের আগে হবে না। তবে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এতদিন যে রাজনৈতিক দলগুলোতে দ্বিধা, অবিশ্বাস, সন্দেহ ছিল, তা কেটেছে। তার অনেকখানি অবসান ঘটবে।’ সরকারের সঙ্গে মনঃস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কমবে বলেও মনে করেন সাইফুল হক।

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি দৃশ্যমান বিচার ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন করতে হবে।’

ইসলামি গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল বলেছেন, ‘দেশের মানুষ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। প্রধান উপদেষ্টা আজকে যে ঘোষণা দিয়েছেন, এটা মনে করি— ইতিবাচক ঘোষণা। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল গুলো মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে দোদুল্যমান অবস্থা ছিল, তার অবসান হবে বলে মনে করি।’ ‘এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সহায়ক হবে। এই ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে স্বাগত জানাই। এতদিন দেশের মানুষের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংশয় ছিল— নির্বাচন হবে কি না, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই অবস্থার অবসান ঘটল।’ সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল বলেন, ‘আমরা মনে করি, জাতি আনন্দমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পারবে। অতীতের মতো ভোট যেন এদিক-ওদিক না হয়, মানুষ যেন তাদের নিজের ভোট নিজে দিতে পারে, সেটা সরকার এবং প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।’

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই মানসিকভাবে ধরে নিয়েছিলাম, তিনি আগেও বলেছিলেন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করবেন। সে হিসেবে ঠিকই আছে। তবে ঘোষণার প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক দলের মধ্যে ক্ষোভ আছে। তিনি এক দলের একনেতার সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যান্য দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি।’