আমার ছেলেকে এনে দাও আমি সইতে পারছি না
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গাজীপুর প্রতিনিধি

ঢাকার গাজীপুরে প্রকাশ্যে দিবালোকে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা। তুহিনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে বইছে শোকের মাতম। ছেলের মৃত্যুতে তুহিনের বৃদ্ধ মা-বাবার কান্না যেন থামছেই না। গতকাল শুক্রবার ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের মধ্য ভাটিপাড়া গ্রামের গিয়ে এমন পরিবেশ দেখা গেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তুহিনের বৃদ্ধ বাবা মো. হাসান জামিল বলেন, ‘ছেলে আমার জন্য ওষুধের টাকা পাঠাতো। আমি সুস্থ আছি কিনা খোঁজখবর নিতো। অসুস্থতার খবর শুনলে মন খারাপ করতো। এ ছেলে আমার কলিজার টুকরা। তাকে জনসম্মুখে খুন করা হল। এটা আমি সইতে পারছি না। তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও।’ তুহিনের বৃদ্ধ বাবা আরও বলেন, ‘পরশু তুহিন আমার জন্য এক হাজার টাকা পাঠিয়েছে। এখন কে আমার জন্য ওষুধ পাঠাবে? তুহিনের কী অপরাধ ছিল? কী অন্যায় করেছিল? হাত-পা ভাইঙা দিলেও ছেলেটাকে জীবিত দেখতে পারতাম। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার মৃত্যুর আগে সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেকে খুন করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিলো। আমার অন্তরটা ফাইট্টা যাইতাছে। আমি কেমনে বুঝাই, বাবা হয়ে এ কষ্ট কতটুকু।’
আহাজারি করতে করতে তুহিনের মা সাহাবিয়া খাতুন বকুল বলেন, ‘এইডা কী হয়্যা গেলো। তুহিন আর আম্মা কয়্যা ডাকতো না। আমার খোঁজখবর নিতো না। আমার ভালা ছেলেটাকে মাইরা ফালাইছে। যারা মারছে এরাও তো মানুষ। মানুষ হয়্যা অমানুষের মতো আমার আদরের ছেলেটাকে মারছে। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ তুহিনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী নূরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘তুহিন ভালো ছেলে ছিল। সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করতো। যারা তুহিনকে মেরেছে তাদের গ্রেফতার চাই, ফাঁসি চাই।’
সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ: গত বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে গাজীপুর নগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় জনসম্মুখে তুহিনকে (৩৮) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই দিন সন্ত্রাসীরা দেশী অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করলে সেই ধাওয়ার ভিডিও করেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান। এরপরই সন্ত্রাসীরা তুহিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনাস্থলের একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এ তথ্য জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশের ভাষ্য: তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার নিহত ব্যক্তির বড় ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নগরের বাসন থানায় মামলাটি করেন। এদিকে ওই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। এ সম্পর্কে বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিন খান বলেন, ‘ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম পরিচয় দিতে পারছি না।’ তবে সিসিটিভি ফুটেজে অস্ত্র হাতে যাদের দেখা গেছে, তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
তুহিনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়ায়। ২০০৫ সাল থেকে গাজীপুরের চান্দনা এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন সাংবাদিক তুহিন। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রবিউল হাসান বলেন, সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যার আগমুহূর্তের কিছু দৃশ্য সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা ধারালো দেশি অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করে। পেছন থেকে সেই দৃশ্য ভিডিও করছিলেন আসাদুজ্জামান। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এই দৃশ্য ভিডিও করায় তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনাস্থল চন্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিট। কালো রঙের জামা পরা এক নারী হেঁটে যাচ্ছেন। পেছন দিক থেকে নীল রঙের জামা পরা এক ব্যক্তি ওই নারীকে পেছন দিক থেকে টেনে ধরেন। নারী জোর করে চলে যেতে চাইলে তার সামনে গিয়ে গতি রোধ করেন ওই ব্যক্তি। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি নারীকে চড়থাপ্পড় মারেন। ঠিক এমন সময় পাশ থেকে ধারালো অস্ত্র হাতে কয়েক যুবক ওই ব্যক্তিকে কোপানোর চেষ্টা করেন। নীল শার্ট পরা ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালিয়ে যান।
ঘটনার কিছু সময় আগে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি দোকানে বসে ছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান ও তার সহকর্মী শামীম হোসেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিক শামীম হোসেন বলেন, ‘চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় আমরা দুজন একদিক থেকে অন্য পাশে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় একজন নারী ও পুরুষ আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যান। এমন সময় কয়েকজন লোক দেশি ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, এই পাইছি, তোরা আয়।’ ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালানো চেষ্টা করেন। তখন তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাকে ধাওয়া করেন। তখন তুহিন (সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন) মুঠোফোন বের করে তাদের পেছনে দৌড় দেন। পরে আমি তুহিনকে খুঁজতে এগিয়ে যাই। অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে তাকায়। তুহিন তখন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে যায়। ঠিক ওই মুহূর্তে ওরাও চায়ের দোকানে ঢুকে ওকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। আমি চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের গাড়ি খুঁজতে থাকি। কোনো গাড়ি দেখতে না পেয়ে বাসন থানার ওসিকে ফোন করি। কিছু সময় পর পুলিশ আসে।’ সিসিটিভি ফুটেজে নারীর সঙ্গে যে ব্যক্তির ধস্তাধস্তি হয়েছিল ও পরে তিনি পালিয়ে যান, ওই ব্যক্তি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার নাম বাদশা মিয়া। তিনি বলেন, ‘ওই মেয়েসহ একটা টিম আছে। ওরা আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর নগরের বাসন, ভোগরা ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি চক্র আছে, যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। সিসিটিভির ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তারা সবাই ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ভিডিওতে যে নারীকে দেখা গেছে, তিনিও ওই চক্রের সদস্য হতে পারেন। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ওই চক্র ছিনতাই করে থাকে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রবিউল হাসান বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের ওই মেয়ে ছিনতাইকারী দলের সদস্য। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে এরই মধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে।’
হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন: তুহিনকে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে গাজীপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সভা করে সাংবাদিক ইউনিয়ন। কর্মরত সাংবাদিকেরা হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান। তারা বলেন, গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি ও ছিনতাইকারীদের মদদদাতাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। আসামিরা চিহ্নিত হয়েছে, তাদের সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরপরও গ্রেপ্তার করতে না পারা প্রশাসনের ব্যর্থতা। গাজীপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন সাংবাদিক ফজলুল হক মোড়ল, ফারদিন ফেরদৌস, মাসুদ রানা, মাজহারুল ইসলাম, মাহমুদা শিকদার, আমিনুল ইসলাম, শরীফ আহমেদ, শাহ শামসুল হক, আজিজুল হক, রেজাউল করিম প্রমুখ।
