রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাত প্রস্তাব ড. ইউনূসের
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এ এইচ সেলিম উল্লাহ ও সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো গতকাল সোমবার সকাল থেকে বুকভরা ক্ষোভ ও চোখভরা অশ্রুতে মুখর হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের ভয়াল দিনটিকে স্মরণ করে লাখো রোহিঙ্গা পালন করল রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস। তারা দাবি জানালেন- নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের। এদিকে, রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর পূর্তিতে কক্সবাজারে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সংলাপে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য সাত দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে যে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন, দাতাদের অব্যাহত সমর্থন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার আহ্বান, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা, গণহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহিতা ত্বরান্বিত করা।
একই সঙ্গে ড. ইউনূস বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, মিয়ানমারের জান্তা ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের ভয়াবহ পরিকল্পনা থেকে বিরত রাখতে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। গতকাল সোমবার সকালে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে ইনানীর হোটেল বে-ওয়াচে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ : টেক অ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’-এর মূল অধিবেশনে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষা করা এবং জাতিগত নিধন প্রতিরোধ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে সংকটের মূলোৎপাটন মিয়ানমারেই ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ স্থিতিশীল আছে এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। এই সংলাপ প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
ড. ইউনূস তার প্রস্তাবিত রূপরেখায় উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন জরুরি। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার অর্থায়নের ঘাটতি পূরণ করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি তহবিল গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে সহিংসতা বন্ধে বাধ্য করতে হবে এবং উত্তেজনা প্রশমনে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ চালু করতে হবে। সীমান্ত অপরাধ দমনে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা এবং এর টেকসই সমাধানকে বৈশ্বিক এজেন্ডায় রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। এই সংহতির চেতনায়, গত রমজান মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস এবং আমি কক্সবাজারে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে একত্রে ইফতার করেছি। আমরা স্পষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের আকুল ইচ্ছা শুনেছি- যত দ্রুত সম্ভব তারা তাদের ঘরে ফিরে যেতে চায়।’
গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিন দফা প্রস্তাব উপস্থাপনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার আহ্বানকে স্বীকৃতি জানিয়ে এ বছরের সাধারণ পরিষদে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমি আশা করি, কক্সবাজারের এই সংলাপ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে যথেষ্ট অবদান রাখবে এবং রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানের রোডম্যাপ তৈরিতে সহায়ক হবে’।
অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বক্তব্যে ২০১৭ সালের আগস্টের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই বর্বরোচিত আক্রমণ ও নিপীড়ন এখনও চলমান।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি বিশ্ব সম্প্রদায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখ, যা কক্সবাজারকে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে পরিণত করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন শিশু রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিচ্ছে, অথচ মিয়ানমারে এখন পাঁচ লাখেরও কম রোহিঙ্গা রয়েছে। এটি প্রমাণ করে, চলমান নিপীড়নের কারণে তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দীর্ঘ আট বছরে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেও সতর্ক করে দেন যে, দেশীয় উৎস থেকে আর কোনো সম্পদ জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই সংকট নিরসনে বৈশ্বিক সহযোগিতা এখন অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত মিয়ানমার থেকে। সমাধানও সেখানেই নিহিত। সকল পক্ষকে দ্রুততম সময়ে কঠিন দৃঢ়তার সঙ্গে এই সংকটের অবসান ঘটাতে হবে।’
রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস আশ্বাস দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ তাদের পাশে রয়েছে এবং তাদের মাতৃভূমিতে দ্রুত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য কাজ চালিয়ে যাবে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘চলুন আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে তাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনে অবদান রাখার অঙ্গীকার করি, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করি।’
সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গাবিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম জানান, বাংলাদেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ইউএনএইচসিআরের সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজু প্রতিশ্রুতি দেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
সংলাপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা সরাসরি বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে তাদের দুঃখ-কষ্ট ও প্রত্যাবাসনের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন। এক তরুণ রোহিঙ্গা প্রতিনিধি বলেন, আমরা বাংলাদেশে আশ্রিত; কিন্তু এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে মিয়ানমারে। জাতিসংঘের প্রতিনিধি সভায় মন্তব্য করেন, রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি জানান, তাদের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে, তবে সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর আরও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এর আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করে স্মরণ করা হয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস’। এতে প্রদর্শিত হয় রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ও সংগ্রাম নিয়ে একটি তথ্যচিত্র। তবে স্থানীয়দের দাবি, আর কথা বা পরিকল্পনা না, এখন সময় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। তাদের মতে, শুধু আলোচনা নয়, নতুন কোনো রোহিঙ্গা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সীমান্ত কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরি। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা এই সংকট যদি দ্রুত সমাধানে না পৌঁছায়, তবে কক্সবাজারে বড় ধরনের সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, এই আন্তর্জাতিক সংলাপে বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশের কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও রোহিঙ্গা নেতারা অংশ নিচ্ছেন। এখানকার সুপারিশগুলো আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে, যেখানে ১৭০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। আজ মঙ্গলবার সম্মেলনের শেষ দিনে বিদেশি অতিথিরা উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন। তারা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন, বাস্তব পরিস্থিতি দেখবেন এবং প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এই অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংলাপে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিকদলের নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যোগ দেন।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ১১ দেশের : রোহিঙ্গা সংকট জটিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের চলমান মানবিক সংকটের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বিশেষ করে আগামী মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক সঙ্গে কাজ করবে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আট বছরপূর্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের ১১টি দেশ বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড এক যৌথ বিবৃতিতে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস তাদের এক্স হ্যান্ডেল এবং ফেসবুক পেইজে যৌথ বিবৃতিটি দিয়েছে। ১১ দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আট বছর পেরোনোর পর আমরা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সেই কর্মকাণ্ড স্মরণ করছি, যার ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছিল। বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছেন। এখনও আশ্রয়শিবিরে থাকতে নতুন করে লোকজন আসছেন।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের দৃঢ়তা ও সহনশীলতাকে সাধুবাদ জানাই, যারা দীর্ঘদিন ধরে কঠিন বাস্তবতা ও বাস্তুচ্যুতি সহ্য করে চলেছেন। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যের বর্তমান অবনতিশীল নিরাপত্তা ও মানবিক পরিস্থিতির মধ্যেও দৃঢ়তা দেখিয়ে চলেছেন তারা।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, যারা রোহিঙ্গাদের, বিশেষ করে নতুন করে আসা লোকজনদেরও আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে চলেছেন এবং জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন।’
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে চায় উল্লেখ করে বিবৃবিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্য পথ খুঁজে বের করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে এখনও সীমান্ত পেরিয়ে বাস্তুচ্যুতি অব্যাহত রয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা রাখাইনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছেন। মিয়ানমারে এখন এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে না, যাতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে ও স্থায়ীভাবে ফিরে যেতে পারেন।
যৌথ বিবৃতিতে ১১ দেশ বলেছে, ‘এই শর্ত পূরণ করতে হলে বাস্তুচ্যুতির মূল কারণগুলোর সমাধান প্রয়োজন, যার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল মিয়ানমার আবশ্যক। তাই আমরা স্বীকার করছি, এখনই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই, সব পক্ষের প্রতি একটি প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।’
বিবৃতিতে ১১টি দেশ বলেছে, ‘আমরা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘটিত সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তীব্র নিন্দা জানাই। সহিংসতা বন্ধ এবং মানবিক সহায়তা অবাধে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আবারও আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা অন্যায়ভাবে আটক ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিও পুনর্ব্যক্ত করছি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
যৌথ বিবৃতি দেওয়া দেশগুলো বলেছে, ‘আমরা আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আরও স্থায়ী সমাধানের পক্ষে। বিশেষ করে যখন রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মানবিক সহায়তার তহবিল কমে আসছে, তেমন পরিস্থিতিতে তাদের ভবিষ্যৎ প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও বলছি। আমরা কক্সবাজারের স্থানীয় বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকেও সমর্থন দিয়ে যাব, যারা উদারভাবে শরণার্থীদের আতিথেয়তা জানাচ্ছেন।’
বিবৃতিতে দেশগুলো বলেছে, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের অর্থবহ অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরছি, যাতে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাবান হতে পারে এবং বাংলাদেশে অবস্থানকালে নিরাপদ, সম্মানজনক ও গঠনমূলক জীবন যাপন করতে পারে। আট বছর পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে এখনো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের পাশে অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এই সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে ওয়াশিংটন : মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আসা এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোকেও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে ওয়াশিংটন। গত রোববার (স্থানীয় সময়) এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রিন্সিপাল ডেপুটি মুখপাত্র টমাস টমি পিগট এ মন্তব্য করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের জনগণের প্রতি সমর্থন জানায়, যার মধ্যে রয়েছে সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুতির শিকার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠী।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখার জন্য প্রশংসা করছি, পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আঞ্চলিক অন্যান্য দেশকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
ঝুপড়ি ঘর ছেড়ে নিজ দেশে ফিরতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ : আশ্রিত জীবনে ঝুপড়ি ঘরে ৮ বছর পার করার পরও নিজ দেশে ফিরতে না পেরে কক্সবাজারের উখিয়ায় সমাবেশ করেছেন রোহিঙ্গারা। গতকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই সমাবেশ করেন ক্যাম্পে বসবাসকারী হাজার হাজার রোহিঙ্গা। দুপুরের দিকে সমাবেশ শেষ হয়।
জানা গেছে, মিয়ানমার জান্তা সরকার রাখাইনে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চালালে ২০১৭ সালর ২৫ আগস্ট লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। এরপর থেকে সাড়ে ১২ লাখের অধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বসবাস করছেন। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে।
রোহিঙ্গা মাঝি বদরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো বাংলাদেশের কেউ নই। আমাদের পরিচয় রোহিঙ্গা। মিয়ানমার সরকার রাখাইনে রোহিঙ্গা জাতির ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রাখাইন থেকে বিতাড়িত করে। তখন থেকে আমরা বাংলাদেশে আশ্রয়ে আছি। বার বার বলছি আমরা নাগরিক অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। আজ ৮ বছর হলো নিজ দেশে একজন রোহিঙ্গাও ফিরতে পারেনি। ক্যাম্পের ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছি।’
রোহিঙ্গা নারী জমিলা বেগম বলেন, রাখাইনে আমাদের ভিটেমাটি সব ছিল। সব ছেড়ে এখন প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছি। নিজ দেশের জন্য পেট পুড়ে। দিন দিন পরিবার বড় হচ্ছে। পরিবারের এতজন সদস্য নিয়ে কীভাবে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করব। আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই। সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে মাস্টার মহিবুল্লাহ অনেক কষ্ট করেছিলেন। বিশ্ববাসীর কাছে রোহিঙ্গাদের কথা তুলে ধরতেন। সেই রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ হত্যার শিকার হলো। বলতে গেলে রোহিঙ্গা জাতি একজন যোগ্য রোহিঙ্গা নেতাকে হারিয়েছে। আমরা চাই না ক্যাম্পে নতুন কোনো ঘটনা সৃষ্টি হোক, এসব পরিহার ও বন্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা আরও বলেন, আজ ৮ বছর হলো আমরা রাখাইন ছেড়ে প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছি। কিন্তু নিজ দেশে ফিরে যেতে পারিনি। বাংলাদেশ সরকারসহ দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো আমাদের মঙ্গলের জন্য অনেক কাজ করছে। এতে আমরা খুশি। কিন্তু বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের একটাই অনুরোধ ও আবেদন আমরা যেন নিজ দেশে নাগরিক অধিকার নিয়ে ফেরত যেতে পারি।
গতকাল সকাল থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও পোস্টার হাতে সমাবেশে যোগদান করেন।
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. সিরাজ আমীন বলেন, ক্যাম্পে আজ রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশ চলাকালীন ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সকাল থেকে শুরু হওয়া সমাবেশ দুপুরের দিকে শেষ হয়।
