ট্রাম্পের শুল্কের চাপে দিশাহারা ভারত
চীনের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা ভারতীয় পণ্যে মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। ট্রাম্পের ঘোষিত মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে। এতে ভারতের অর্থনীতির বড় একটা অংশ ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। মূলত শুল্কের চাপে ভারতীয় শিল্পকারখানাগুলো কার্যত ধুঁকছে এবং শ্রমিকদের বেতন দেওয়া নিয়েও সংশয়ের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, তামিলনাডুর তিরুপ্পুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্বাভাবিক নীরবতা। ভারতের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল রপ্তানি কেন্দ্র এই শহরে একসময় গমগম করত সেলাই মেশিনের শব্দ। কিন্তু এন কৃষ্ণমূর্তির কারখানায় এখন ২০০টির মধ্যে সামান্য কিছু মেশিনই চালু আছে। মার্কিন বাজারে শিশুদের পোশাকের শেষ অর্ডারগুলো সম্পন্ন করছেন শ্রমিকরা। কোণায় পড়ে থাকা নতুন ডিজাইনের কাপড়ের নমুনাগুলোয় জমেছে ধুলো। কারণ, বুধবার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ৫০ শতাংশ শুল্ক, যা ভারতের রপ্তানির জন্য বড় ধাক্কা।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, চিংড়ি, রত্ন ও গয়নার বড় রপ্তানিকারক। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্কের এই মাত্রা কার্যত ভারতীয় পণ্যের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞার মতো। এর সঙ্গে রাশিয়ার তেল ও অস্ত্র কেনায় আরও ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক যুক্ত হয়েছে।
বিবিসির সংবাদদাতারা ভারতের বিভিন্ন রপ্তানি কেন্দ্রে ঘুরে দেখেছেন, এই অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জীবন-জীবিকায় কেমন প্রভাব ফেলছে। তিরুপ্পুর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট, টার্গেট, গ্যাপ ও জারার মতো ব্র্যান্ডে বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা ভারতের মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ। সেখানে এখন গভীর উদ্বেগ। কৃষ্ণমূর্তি বললেন, ‘সেপ্টেম্বরের পর থেকে হয়তো করার মতো কিছুই থাকবে না।’ অর্ডার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন এবং সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া ২৫০ শ্রমিককে বসিয়ে রাখতে হয়েছে। শুল্ক ঘোষণার সময়টিও রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়েছে। কারণ, বছরের প্রায় অর্ধেক বিক্রিই হয় বড়দিনকে ঘিরে এই মৌসুমে। এখন তারা ভরসা করছেন স্থানীয় বাজার ও আসন্ন দীপাবলি মৌসুমের ওপর।
অন্য এক অন্তর্বাস প্রস্তুতকারকের কারখানায় প্রায় ১০ লাখ ডলারের পণ্য মজুত পড়ে আছে— কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার মতো ক্রেতা নেই। রাফট গার্মেন্টসের মালিক শিব সুব্রামানিয়াম বললেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি হবে। গত মাস থেকে পুরো উৎপাদন বন্ধ হয়ে আছে। এভাবে চলতে থাকলে শ্রমিকদের বেতন দেব কিভাবে?’
৫০ শতাংশ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ ডলারের ভারতীয় শার্ট এখন বিক্রি হবে ১৬.৪ ডলারে। অথচ একই পণ্য চীন থেকে পাওয়া যায় ১৪.২, বাংলাদেশ থেকে ১৩.২ আর ভিয়েতনাম থেকে ১২ ডলারে। এমনকি শুল্ক ২৫ শতাংশে নেমে এলেও ভারত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে। ক্ষতি কিছুটা সামলাতে ভারত সরকার কাঁচামালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারসহ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিকল্প বাজার খুঁজতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনাও জোরদার হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পদক্ষেপগুলো অনেক দেরিতে এসেছে।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বললেন, ‘আমরা বাণিজ্য মোড় ঘুরতে দেখব। মার্কিন ক্রেতারা চলে যাবে মেক্সিকো, ভিয়েতনাম কিংবা বাংলাদেশে।’
এদিকে মুম্বাইয়ের রপ্তানি অঞ্চলে শত শত শ্রমিক হীরার পাথর মসৃণ ও প্যাকেজিং করছেন। ভারতের ১০ বিলিয়ন ডলারের রত্ন ও গয়না রপ্তানির বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলারের গয়না সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু শুল্ক আরোপের জেরে বিক্রি কমে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল এই শিল্পে এখন মাসে গড়ে মাত্র ১৫ দিন কাজ হচ্ছে। অনেক চুক্তিভিত্তিক শ্রমিককে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সুরাটের এক কারখানা মালিক শৈলেশ মাঙ্গুকিয়া বললেন, আগে ৩০০ শ্রমিক ছিল, এখন মাত্র ৭০ জন। মাসে যেখানে ২ হাজার হীরা মসৃণ করা হতো, এখন নেমে এসেছে ৩০০টিতে।
স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ভবেশ ট্যাঙ্ক বললেন, “শ্রমিকদের আয় কমছে, অনিচ্ছাকৃত ছুটি বাড়ছে, মাসিক বেতন ক্রমেই কমছে।”
ভারতের চিংড়ি খামারিরাও বড় ক্ষতির মুখে। বিশ্বের অন্যতম বড় চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ ভারত। যুক্তরাষ্ট্র এর প্রধান বাজার। নতুন শুল্কের কারণে এই খাতে মোট শুল্ক ৬০ শতাংশের বেশি হবে। দামও কমেছে কেজিতে ৬০-৭২ সেন্ট। আরও কমতে পারে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের এক রপ্তানিকারক ঠোটা জগদীশ বললেন, “এটা আমাদের মৌসুম। মার্কিন ক্রেতারা বড়দিন ও নববর্ষের প্রস্তুতি নেয় এই সময়ে। কিন্তু শুল্কের কারণে আমরা কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।” অনেক হ্যাচারি উৎপাদনও কমিয়ে দিয়েছে। ভীরাবাসারামের এমএস বর্মা বললেন, “আগে আমরা বছরে ১০ কোটি লার্ভা উৎপাদন করতাম। এখন ৬-৭ কোটি ছুঁতেও পারছি না।” এমন অবস্থায় এই খাতে সরাসরি পাঁচ লাখ ও পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষের জীবিকা হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেটিও আবার এমন সময়ে যখন ভারতে কর্মসংস্থানের সংকট গভীর। আর তাই এই পরিস্থিতি উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অচলাবস্থা এখনও কাটেনি। বরং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আলোচনার পরিবেশ আরও খারাপ হয়েছে। দিল্লিতে নির্ধারিত নতুন বাণিজ্য আলোচনা বাতিল হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতকে “চীনের ঘনিষ্ঠ” ও “রাশিয়ার মানি লন্ডারিংয়ের জায়গা” বলে কটাক্ষ করেছেন।
এশিয়া গ্রুপ অ্যাডভাইজরির গোপাল নাদ্দুর বললেন, “ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারের ওপর— যার মধ্যে ঘরোয়া রাজনীতি ছাড়াও রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি আরও বলছেন, “ভারতের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের জন্য এখন মন্ত্র একটাই— আত্মনির্ভরতা বাড়াও, বাজার বৈচিত্র্য করো এবং কোনো সুযোগ হাতছাড়া করো না।”
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আরও তীব্র হচ্ছে শুল্ক বিরোধ! এবার চীনের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বেশি চুম্বক দিতে হবে, না হলে চীনের ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হবে। ট্রাম্প বলেছেন, ‘চীন যদি আমাদের চুম্বক না দেয়, তবে তাদের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক বসাতে হবে বা এ রকম কিছু করতে হবে।’ দুই দেশের বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে এমন মন্তব্য এলো যখন বিরল খনিজ ও চুম্বকের সরবরাহ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে চীন। দুর্লভ খনিজ উপাদান নিয়ে বেইজিং অত্যন্ত সংবেদনশীল। গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন বেশ কিছু দুর্লভ খনিজ ও ম্যাগনেট রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। বর্তমানে বৈশ্বিক ম্যাগনেট বাজারের প্রায় ৯০ শতাংশই চীনের দখলে। এসব উপাদান সেমিকন্ডাক্টর চিপসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে অপরিহার্য, যার ব্যবহার রয়েছে স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তিপণ্যে।
ট্রাম্পের এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেল করপোরেশনে ১০ শতাংশ শেয়ার নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সেমিকন্ডাক্টর চিপ প্রস্তুতকারী এই কোম্পানি দুর্লভ খনিজ উপাদানের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ট্রাম্প আরও বলেন যে, ‘তাদের ২০০টি বিমান উড়তে অক্ষম ছিল কারণ আমরা বোয়িংকে যন্ত্রাংশ দিতে পারিনি কারণ চীন আমাদের চুম্বক দিচ্ছিল না।’ ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোয়িং চীনের কাছে ৫০০টিরও বেশি বিমান বিক্রির চুক্তির দিকে কাজ করছে, যেখানে উভয় পক্ষই জেট মডেল, ধরণ এবং ডেলিভারি সময়সূচীর মতো বিশদ বিবরণ চূড়ান্ত করছে। এই চুক্তির মাধ্যমে সম্ভাব্য মার্কিন-চীন বাণিজ্য চুক্তিতে বিমান জেটের ভূমিকার উপর জোর দেয়া হয়েছে। জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো চুম্বকের রপ্তানি আগের মাসের তুলনায় সাত গুণেরও বেশি- ৬৬ % - বৃদ্ধি পেয়েছে, জুলাই মাসে এর পরিমাণ ৭৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। বেইজিং-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হেনরি ওয়াং বলেছেন, ট্রাম্পের এই অকপট মন্তব্য বেইজিংয়ের সাথে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের আগ্রহের দিকে ইঙ্গিত দেয়। ওয়াং বলেন, ‘ট্রাম্প সম্ভাব্য শাস্তির বিষয়ে বড় বড় কথা বলছেন, কিন্তু আমাদের সেদিকে মন দেয়া উচিত নয়। আসল নজর দেয়া উচিত উভয় পক্ষের তাদের চুক্তি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার উপর।’ জুন মাসে, ওয়াশিংটন এবং বেইজিং একটি বাণিজ্য কাঠামোতে সম্মত হয়েছিল যার মধ্যে ছিল চীনা বিরল-খনিজ রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা এবং চীনে চালানের জন্য কিছু আমেরিকান প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের পণ্যের উপর শুল্ক যথাক্রমে প্রায় ৫৫% এবং ৩২% এ কমিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে। মঙ্গলবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের সিনিয়র বাণিজ্য আলোচক লি চেংগ্যাং মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার এবং ট্রেজারি কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের জন্য এই সপ্তাহে ওয়াশিংটন যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। উপদেষ্টা সংস্থা গ্রিনপয়েন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলফ্রেডো মন্টুফার-হেলু বলেন, নভেম্বরের শেষ তারিখের পরেও বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি টিকবে কিনা তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করবে। লির আসন্ন বৈঠকগুলো উচ্চণ্ডস্তরের আলোচনা এবং উত্তেজনা কমানোর জন্য স্থায়ী সমাধানের ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
