তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে স্থায়ী সমাধান চান প্রধান বিচারপতি

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। গতকাল বুধবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) শুনানির দ্বিতীয় দিনে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা এমনভাবে নির্ধারিত হতে হবে, যাতে তা বারবার সংকটে না পড়ে এবং দেশের গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে শক্তিশালী করে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিই, এটি কবে থেকে কার্যকর হবে?’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সুস্পষ্ট ও স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে এটি নিয়ে সংকট সৃষ্টি না হয়। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এটি যাতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে, সেটিই করা হবে।’

এর আগে গত মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। আপিল শুনানির জন্য ২১ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়েছে। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করছেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

হাসিনা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান: অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান, ভূতের মুখে রাম নাম। বুধবার অ্যাটর্নি জেনারেলের নিজ কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি একথা বলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে শুনানির অনুমতি দেওয়ার পর ব্রিফিংয়ে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) বাতিল ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দিয়েছিলেন। আমরা আজকে আদালতে বলেছি, এখন আবার আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরতে চাই। আমরা মনে করি, দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসবে। এর ফলে আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না, কোনো মা-বাবা তার সন্তান হারাবেন না, কোনো ভাই তার ভাইকে হারাবে না, কোনো সন্তান তার মা-বাবাকে হারাবে না। আর কখনো রক্ত দিয়ে ভোটের ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে হবে না। তিনি আরও বলেন, আগের সরকার বলতো কখনো অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা থাকতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার নিজেই ছিল অনির্বাচিত। আমরা তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ছিলাম। এখন আবার ভূতের মুখে রাম নাম। শেখ হাসিনাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চায়।

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে তৎকালীন বিএনপি সরকার।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ১৯৯৮ সালে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী। পরে বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ৪ অগাস্ট সেই রিট খারিজ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধই থাকে। হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করেন রিট আবেদনকারীরা। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় ৮ জন আইনজীবী বক্তব্য দেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন। ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিসহ ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদন জমা পড়ে। গত বছরের ২৭ অগাস্ট একটি আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। একই বছরের ১৬ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও একটি রিভিউ আবেদন করেন। এছাড়া নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর একটি আবেদন করেন। এ চার রিভিউ আবেদনের একসঙ্গে শুনানি শুরু হয় মঙ্গলবার। আবেদনকারীরা রিভিউ শুনানি থেকে রায় চাইলেও আপিল বিভাগ নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দিল। গত ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। ফলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফেরার পথ তৈরি হয়।