ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রণক্ষেত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আহত দুই শতাধিক

* ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের আঘাত * ১৪৪ ধারা জারি, যৌথবাহিনীর অভিযান *প্রশাসনের সহায়তা না পেয়ে কাঁদলেন চবির সহ-উপাচার্য * শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ
রণক্ষেত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আহত দুই শতাধিক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের মধ্যে শনিবার রাত এবং গতকাল রোববার দিনভর দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সারাদিন থমথমে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকা। সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাধিক বলে চবি মেডিকেল সেন্টার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি এবং সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে স্থগিত রাখা হয়েছে সব পরীক্ষা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট সংলগ্ন একটি ভবনের ভাড়াটিয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর বাক-বিতণ্ডার জেরে শনিবার মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সূত্রপাত। শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী রাত ১১টার দিকে বাসায় ফেরেন। ভবনের গেইট বন্ধ থাকায় তিনি প্রহরীকে ডাকাডাকি করেন। এ সময় প্রহরী এসে ওই ছাত্রীর সঙ্গে তর্কে জড়ান। এক পর্যায়ে ওই ছাত্রীকে তিনি গালাগাল করেন এবং চড় মারেন। ওই ছাত্রী তিনি সহপাঠীদের খবর দিলে তারা সেখানে যান এবং গ্রামবাসীও ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করেন। তখন দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। দুই পক্ষই ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে পরস্পরকে ধাওয়া করে। এ সময় স্থানীয়রা মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। স্থানীয় লোকজন সে সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বলেও অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফের সংঘর্ষ: বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট এলাকায় আবারও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় গ্রামবাসী। দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং ঢিল ছোড়াছোড়ির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। স্থানীয় লোকজন আবারও সড়কে অবস্থান নিতে শুরু করে। দুই নম্বর গেইট এলাকার বিভিন্ন ভাড়া বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা থাকেন, তারা যার যার বাসায় আটকা পড়ে যান। ক্যাম্পাস থেকে ছোট ছোট দলে শিক্ষার্থীরা ওই এলাকায় যাওয়া শুরু করেন। ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে দুই নম্বর গেইট এলাকায় গেলে ফের স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। তখন উপ উপাচার্য কামাল উদ্দিনসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকজন পরিস্থিতি শান্ত করতে সেখানে যান। কিন্তু সংঘর্ষের মধ্যে ইটের আঘাতে উপ-উপচার্য নিজেও আহত হন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজন বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছে। দুই পক্ষ দুই দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন এবং ঢিল ছুড়ছে। চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) রাসেল বলেন, “আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি। এখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।” এর আগে, রাত ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মো. হায়দার আরিফ ফেইসবুকে পোস্টে দিয়ে সবার সহযোগিতা চান। তিনি লেখেন, “দুই নম্বরে (গেইটে) আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষে প্রচুর শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। সহকারী প্রক্টর কুরবান আলী স্যার, নাজমুল স্যার ও নিরাপত্তা প্রধান রহিম ভাই আহত। নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকেই আহত। প্রক্টোরিয়াল বডি, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ভায়চুর করা হয়েছে।” রাত সাড়ে ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে গেলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয় বলে উপ উপাচার্য (প্রশাসন) কামাল উদ্দিন ভোরের দিকে জানিয়েছিলেন। তিনি সে সময় বলেছিলেন, “পর্যাপ্ত পুলিশ আমরা ঘটনাস্থলে পাইনি। র‌্যাবের সাথে যোগাযোগ করেও তাদের পাইনি। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী আসছে। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।” চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, ২১ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। রাতভর সংঘর্ষের পর গতকাল রোববার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে যোগ দেননি।

সংঘর্ষে আহত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) গত শনিবার রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত (রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলামের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে পাঠানো হয়েছে। আহতদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও প্রক্টরও রয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, দুদিনে আহতের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। চবি মেডিক্যাল সেন্টারে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. ফারহানা বলেন, ‘সকাল থেকে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়ে চবি মেডিকাল সেন্টারে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কমপক্ষে ২৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমার কর্মজীবনে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী একসঙ্গে হতাহতের ঘটনা ঘটতে দেখিনি।’

প্রশাসনের সহায়তা না পেয়ে কাঁদলেন চবির সহ-উপাচার্য: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কোনও ধরনের সহায়তা না পাওয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন। তার কান্না দেখে শিক্ষার্থীরাও কেঁদেছেন। ইতিমধ্যে এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালে আহত শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এ সময় অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি কম্পারেটিভলি ভালো আছি। আমার ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি আহত। আমরা এখন পর্যন্ত আর্মি-বিজিবির কোনও সহায়তা পাচ্ছি না। প্রত্যাক ছাত্রকে তারা দা দিয়ে কোপাচ্ছে। এটা কোন জগতে আছি আমরা। আপনারা আমাদের ছাত্রদের উদ্ধার করুন। আমাদের প্রক্টর, প্রো-ভিসি আহত। আমাদের প্রায় সব শিক্ষক-ছাত্র আহত। আমরা মেডিক্যালে জায়গা দিতে পারতেছি না। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা হেলমেট পরে আমাদের ছাত্রদের মারতেছে। আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার দফতরে কথা বলেছি, কিন্তু এখনও আমাদের পাশে কেউ নেই।’

১৪৪ ধারা জারি : শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনায় ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। গতকাল দুপুরে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

যৌথবাহিনীর অভিযান : দফায় দফায় সংঘর্ষ শেষে অভিযানে যৌথবাহিনী। বিকেল ৪টার দিকে যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করেন। এসময় ক্যাম্পাসের আশপাশে যৌথবাহিনীর অন্তত ১০টি গাড়ি প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এর আগে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকায় সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। জানা যায়, দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত টানা সংঘর্ষ চললেও এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। বিকেল সাড়ে ৩টায় হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন সই করা বিজ্ঞপ্তিতে ১৪৪ ধারা চালু হলে এর প্রায় ৩০ মিনিট পরে ঘটনাস্থলে আসেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শিবিরের বিক্ষোভ: মধ্যরাতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী মোড়ে বিক্ষোভ শুরু করে তারা। এরপর জিরোপয়েন্টে এসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। অবস্থান কর্মসূচিতে শিবির প্রশাসনের প্রতি ৪ দফা দাবি জানায়। দাবিগুলো হলো: ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার বিচার নিশ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তা চৌকি বসানো, পুরো ক্যাম্পাস সিসিটিভির আওতায় আনা এবং হামলার সঙ্গে জড়িত হানিফ গংকে গ্রেফতার করা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত