
পাকিস্তান সীমান্তসংলগ্ন আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য প্রদেশ কুনার ও নানগারহারে আঘাত হানা ভূমিকম্পে প্রায় ৮০০ জন নিহত হয়েছেন। শত শত মানুষ আহত হয়েছেন এবং অগণিত পরিবার নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। আফগান সরকারের মুখপাত্র মৌলভি জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮০০ হয়েছে। আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজারে। এক সংবাদ সম্মেলনে জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, উদ্ধার কাজ চলছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় গত রোববার রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ৮ কিলোমিটার গভীরে। ওই ভূমিকম্পের পর রাতেই নানগারহার ও কুনার প্রদেশে অন্তত ১৩টি পরাঘাত অনুভূত হওয়ার কথা বিবিসিকে জানান স্থানীয় একজন বাসিন্দা।
পোলাদ নূরি নামে ২৮ বছরের একজন বলেন, ‘এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প আমি আমার জীবনে আগে কখনো দেখিনি।’ আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রাথমিক খবরে জানা গেছে, কেবল একটি গ্রামেই ৩০ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযান চলছে। তবে ভূমিকম্পের পর দুর্গম পার্বত্য এলাকায় অনেক জায়গায় ভূমিধসে সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধারকাজ। আকাশপথে উদ্ধার অভিযান চালাতে সহায়তা দিতে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সহায়তা সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তালেবান সরকারের কর্মকর্তারা।
মার্কিন সহায়তা স্থগিতে নাজেহাল আফগানিস্তান : ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আফগান কর্তৃপক্ষ। এই চাপ আরও প্রকট হয়েছে মার্কিন সহায়তা স্থগিতের কারণে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ বোঝাতে স্থানীয় এক সংবাদকর্মী জানিয়েছেন, আহতদের সঙ্গে আসা স্বজনরাই রোগীদের হাসপাতালে রেখে ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে ছোটাছুটি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
দেশটির শাসনক্ষমতা তালেবান দখলের পর থেকেই আন্তর্জাতিকভাবে বহুমুখী চাপে আছে আফগান সরকার। বিশেষত নারীদের দাবিয়ে রাখতে বৈষম্যমূলক একাধিক নীতি প্রণয়নের কারণে বিশ্বব্যাপী তালেবান সরকার ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সহায়তা আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া না হলেও, মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির তহবিল আকস্মিকভাবে স্থগিত হয়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যায় কাবুল। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এটি আফগানিস্তানের তৃতীয় ভয়াবহ ভূমিকম্প। মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর আন্তর্জাতিক তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারি অর্থায়নে সংকট দেখা দেয়।এমনকি মানবিক সহায়তাও ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ২০২২ সালে ৩৮০ কোটি ডলার থেকে চলতি বছর কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭৬ দশমিক ৭ কোটি ডলার। দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থা ও সীমান্তবর্তী পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার আফগান অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর কারণে এমনিতেই বহুবিধ চাপে রয়েছে জালালাবাদ এলাকা। এরমধ্যে ভূমিকম্পে আহত শত শত মানুষের সেবা দিতে গিয়ে প্রায় নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অধিকাংশ আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে এখানকার হাসপাতালেই নেওয়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়ে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শারাফাত জামান বলেন, এখানে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং অনেকে গৃহহীন হয়েছে। এখন আমাদের সহায়তা দরকার।
রিখটার স্কেলে ছয় মাত্রার ভূমিকম্পটি আফগানিস্তানে মধ্যরাতে আঘাত হানে।তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানান, পূর্বাঞ্চলীয় কুনার ও নানগারহার প্রদেশে মোট ৮১২ জন নিহত হয়েছেন। সীমান্তবর্তী দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে মাটির ঘরবাড়ি ধস এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় উদ্ধারকাজ চালানো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশটির কর্তৃপক্ষের বরাতে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, এখন পর্যন্ত অন্তত দুহাজার ৮০০ মানুষ আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আবদুল মাতেন কানাই বলেন, নিরাপত্তা থেকে শুরু করে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা সব ক্ষেত্রেই পূর্ণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সব ধরনের দল মোতায়েন করা হয়েছে।
রয়টার্স টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা গেছে, হেলিকপ্টারে আহতদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা নিরাপত্তা বাহিনী ও চিকিৎসাকর্মীদের সঙ্গে মিলে অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন। প্রকাশ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, আহতদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে নিতে উদ্ধারকর্মীদের সহায়তা করছেন স্থানীয়রা। এর আগে ২০২২ সালে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় এক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
জামায়াতের শোক : আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে শত শত প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, “৩১ আগস্ট দিবাগত গভীর রাতে আফগানিস্তানের দুটি দুর্গম প্রদেশে সংঘটিত ভয়াল ভূমিকম্পে মুহূর্তের মধ্যে হাজারো মানুষের স্বপ্ন, আশা ও ভালোবাসার ঠিকানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৮০০ জনের অধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, শত শত মানুষ আহত হয়েছেন এবং অগণিত পরিবার নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। এ হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে গভীরতম শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। তিনি আরও বলেন, যেসব মা তাদের সন্তান হারিয়েছেন, যেসব শিশু এক নিমিষে পিতৃহীন হয়েছে, যেসব পরিবার তাদের আশ্রয় ও প্রিয়জন হারিয়ে আজ অশ্রুতে ভাসছে, তাদের বেদনা ভাষায় প্রকাশের অতীত। এ শোক শুধু আফগানিস্তানের নয়, এ শোক সমগ্র মানবতার শোক। বাংলাদেশের জনগণও এই দুঃসময় আফগান ভাই-বোনদের পাশে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি, আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আফগানিস্তানের ভাই-বোনদের এই কঠিন বিপর্যয় ধৈর্য ও সাহসের সাথে অতিক্রম করার তাওফিক দান করেন।”