চবিতে সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ২১ সদস্যের কমিটি

* ১৪৪ জারি রাখাসহ ৪ দাবি ছাত্রশিবিরের * লাইফ সাপোর্টে দুই শিক্ষার্থী একজনকে ঢাকায় স্থানান্তর

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত তিন শতাধিক আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এরমধ্যে দুই জন শিক্ষার্থীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আরেকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গতকালও ১৪৪ ধারা অব্যাহত ছিল। ঘটনা তদন্তে সংঘর্ষে আহত উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিনকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি। এদিকে, ছাত্রশিবির চবি শাখা প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে চার দফা দাবি জানিয়েছে।

সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটি : শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রশাসন। গতকাল সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর শামীম উদ্দীন খান। তিনি জানান, সংঘর্ষে আহত উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিনকে এই কমিটির প্রধান করে ২১ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া কমিটিতে সিন্ডিকেট সদস্য, সাবেক ভিপি ও স্থানীয় বিএনপি নেতা এস এম ফজলুল হকসহ অন্যান্য ছাত্র প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। প্রফেসর শামীম উদ্দীন খান বলেন, ‘বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার নিষ্ক্রিয় থাকায় ছাত্ররা এবং এলাকাবাসী উত্তেজিত হওয়ার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় রোববার সন্ধ্যার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।’

১৪৪ ধারা জারি রাখাসহ ৪ দাবি শিবিরের : ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সংবাদ সম্মেলনে তারা ১৪৪ ধারা জারি রাখাসহ প্রশাসনের কাছে চারটি দাবি জানিয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানায় শিবির। সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির সভাপতি মোহাম্মদ আলী। এ সময় তিনি গত শনিবার রাত এবং রোববার দিনব্যাপী চবি শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের বর্বরোচিত হামলা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হাটহাজারী পুলিশ প্রশাসন এবং দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর নীরব ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানান। সংবাদ সম্মেলনে শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ইব্রাহিম হোসেন রনি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি মোহাম্মদ পারভেজসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। শিবিরের চার দাবি- প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আহত শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে হবে এবং পুরো এলাকা অস্ত্রমুক্ত করতে হবে। ক্যাম্পাসের স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি রাখতে হবে।

লাইফ সাপোর্টে দুই শিক্ষার্থী : স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে গুরুতর আহত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে অবস্থার অবনতি হওয়ায় দু’জনকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহত আরেক শিক্ষার্থীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত রোববার রাতে নগরীর পাঁচলাইশে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই শিক্ষার্থীকে সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। এরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইমতিয়াজ আহমেদ (২৪) ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের মামুন মিয়া (২৩)। এছাড়া, বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলামকে (২৪) ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তিনি রক্তনালীতে আঘাতজনিত (ভাস্কুলার ইনজুরি) কারণে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত রোববার রাত ১০টার দিকে অস্ত্রোপচারের পর তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে আহত ইমতিয়াজ ও মামুন মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদেরও গত রোববার রাতে অস্ত্রোপচার হয়। এর পর অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাদের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জোবরা গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহতদের চিকিৎসার বিষয়টি আমরা মনিটরিং করছি। সংঘর্ষে তিন শতাধিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুজন লাইফ সাপোর্টে আছেন। একজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বাকিরা আশঙ্কামুক্ত। এদের অধিকাংশই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন।’ সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, রোববার বিকেল পর্যন্ত সংঘর্ষে আহত ১১৪ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে আরও ৩০ জন চিকিৎসা নিতে যান। এ ছাড়া, প্রায় ৩০০ জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। সর্বশেষ গতকাল সোমবার দুপুর নাগাদ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আটজন এবং বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ছয়জন চিকিৎসাধীন আছেন। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেইট সংলগ্ন একটি ভবনের ভাড়াটিয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর বাক-বিতণ্ডার জেরে গত শনিবার মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী রাত ১১টার দিকে বাসায় ফেরেন। ভবনের গেইট বন্ধ থাকায় তিনি প্রহরীকে ডাকাডাকি করেন। এসময় প্রহরী এসে ওই ছাত্রীর সঙ্গে তর্কে জড়ায়। এক পর্যায়ে ওই ছাত্রীকে তিনি গালাগাল করেন এবং চড় মারেন। ওই ছাত্রী তখন সহপাঠীদের খবর দিলে তারা সেখানে যান এবং গ্রামবাসীও ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে। তখন দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। দুই পক্ষই ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে পরস্পরকে ধাওয়া করে। এসময় স্থানীয়রা মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। স্থানীয় লোকজন সে সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বলেও অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি ও সেনা মোতায়েন করা হয়; স্থগিত করা হয় সব পরীক্ষা।