চবি শিক্ষার্থী-স্থানীয় সংঘর্ষ

এক হাজার জনকে আসামি করে মামলা

* চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তর থেকে অস্ত্র লুট * উপাচার্য, প্রক্টরের পদত্যাগ ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ছাত্রদলের বিক্ষোভ

প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত ক্যাম্পাস। এরইমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তর থেকে অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। গত রোববার দুপুরে চবির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জোবরা এলাকার গ্রামবাসীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে উভয়পক্ষ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোটা ব্যবহারের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী আহত হন। এসময় উত্তেজিত একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর চবির বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে জব্দ করা দেশীয় অস্ত্র নিরাপত্তা দপ্তরে সংরক্ষণ করা ছিল। সংঘর্ষের সময় সেখান থেকে অস্ত্রগুলো চুরি হয়। প্রশাসনের দাবি, প্রায় ১৩০টি রামদা ওই অস্ত্রাগার থেকে লুট হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যাদের কাছে এসব চুরিকৃত অস্ত্র রয়েছে, তাদেরকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিরাপত্তা দপ্তরে জমা দিতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে সহকারী প্রক্টর নাজমূল হোসাইন বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন হল থেকে প্রায় ১৬০টি রামদা জব্দ করে নিরাপত্তা দপ্তরে সংরক্ষণ করেছিল। এই অস্ত্রাগার লুট করার জন্য ৬টি তালা ভাঙা হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা কর্মীদের মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে। এমনকি তারা শিক্ষার্থীদের কাছে হাতজোড় করেছেন। উপ-উপাচার্য (এডমিন) স্যারও অনুরোধ করেছিলেন- ‘তোমরা এটা কর না, এটা ভালো দেখাবে না।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারিনি। প্রায় ১৩০টি রামদা লুট হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সব ছাত্র সংগঠনের সহযোগিতা চাই। কারণ এই অস্ত্র লুট একসময় শিক্ষার্থীদের জন্যই বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।”

চবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, অস্ত্র লুটের ঘটনায় হাটহাজারী থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হয়েছে। সেখানে অজ্ঞাতপরিচয় ৮০০-১০০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বাদী হিসেবে নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান আব্দুর রহিম রয়েছেন।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে টানা দুই দিনের সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় একটি মামলা ও একটি জিডি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মামলায় ৯৮ জনের নাম উল্লেখ করে এক হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়া চবির নিরাপত্তা দফতরের দেশীয় অস্ত্র লুটের ঘটনায় একটি জিডি করা হয়েছে। তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় একটি মামলা আর একটি জিডি করা হয়েছে। আর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা করার সব করছি। শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করবো তারা যেন দ্রুত ক্লাস-পরীক্ষায় ফেরে। শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

হাটহাজারী থানার ওসি আবু কাউসার মোহাম্মদ হোসেন বলেন, চবিতে সংঘর্ষের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।

উল্লেখ্য, গত শনিবার (৩০ আগস্ট) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন একটি ভবনের ভাড়াটিয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর বাগবিতণ্ডার জেরে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। রাতে শুরু হওয়া ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া আর সংঘর্ষ পরদিন রবিবারও চলেছে দফায় দফায়। তাতে শিক্ষার্থী, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য, উপ-উপাচার্যসহ কয়েকশ’ ব্যক্তি আহত হন। সংঘাতের মধ্যে রবিবার দুপুর ২টা থেকে ক্যাম্পাস ও আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সেটি এখনও বহাল আছে।

গত সোমবার বিকালে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয়, গ্রামবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রে তিন শতাধিক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১৪ জন, নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ৩০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।

এর মধ্যে গত সোমবার বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে দুই জন লাইফ সাপোর্টে এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জন ভর্তি আছেন।

এ ছাড়া এক শিক্ষার্থীর রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার এনআইসিবিডি’তে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার) পাঠানো হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর হোসেন।

অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও চবির উপাচার্য, প্রক্টরের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করছে শাখা ছাত্রদল। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তারা ‘উপাচার্য হায় হায়, নিরাপত্তার খবর নাই’, ‘দফা এক দাবি এক, প্রশাসনের পদত্যাগ’, ‘এক দুই তিন চার, প্রশাসন গদি ছাড়’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত ঝরে, প্রশাসন নিয়োগ করে’, ‘বাহ ভিসি চমৎকার, সন্ত্রাসীদের পাহারাদার’, ‘আহতদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, অবিলম্বে করতে হবে’, ‘সন্ত্রাসীদের কালো হাত, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, চবি প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দুদিন ধরে যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে, এতে প্রশাসন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে আমাদের এত শিক্ষার্থী আহত হতো না। ঘটনার পেছনে প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তির ইন্ধন এবং বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা আছে। তাই এই ব্যর্থ প্রশাসনের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, যেসব সন্ত্রাসী আমাদের ভাইদের কুপিয়েছে, বর্বরোচিতভাবে আহত করেছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনি শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং সংঘর্ষে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় আমরা এ প্রশাসনের পদত্যাগ চাই। এটি তাদের দলীয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থী ভাইদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। কিন্তু ঘটনার তিনদিন হয়ে গেলেও চবি প্রশাসনের এখনো কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।