
বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আসামিদের খালাসের রায় বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ গতকাল বৃহস্পতিবার এ রায় দেন।
জানা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর গত ২১ আগস্ট পঞ্চম দিনে শুনানি শেষ হয়। আদালত রায়ের জন্য ৪ সেপ্টেম্বর তারিখ ধার্য করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল সর্বসম্মতিতে রায় দেন আপিল বিভাগ।
গতকাল আপিল বিভাগের খালাসের রায়ের পর প্রতিক্রিয়া বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ন্যায়বিচার পেয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে তারেক রহমান নির্দোষ।
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত জিঘাংসা থেকে তারেক রহমানকে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অন্যায়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে তারেক রহমান নির্দোষ, এ কারণে তিনি খালাস পেয়েছেন। এই রায়ের মাধ্যমে এটাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শেখ হাসিনা প্রকৃত অর্থে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার চাননি। যদি শেখ হাসিনা প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চাইতেন, আইভী রহমান হত্যার বিচার চাইতেন তাহলে জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে তারেক রহমানকে অন্তর্ভুক্ত করতেন না। আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।’
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার, রাসেল আহমেদ এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল লাবনী আক্তার। আবদুস সালাম পিন্টুসহ দণ্ডিত বেশ কয়েকজনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান। এছাড়া লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও তিন আসামির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। এছাড়াও বিএনপি নেতাদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল প্রমুখ।
হাইকোর্টের রায় ন্যায়সংগত, নতুন তদন্তের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার : তথ্য-প্রমাণ, পরিস্থিতি ও আইনি দিক পর্যালোচনা করে অভিমতে আদালত বলেন, হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) খারিজ, আপিল (বিচারিক আদালতের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল) মঞ্জুর ও বিবিধ আবেদনে রুল যথাযথ ঘোষণার পর আপিলকারী ও যারা আপিল করেননি তাদের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের দোষীসাব্যস্তকরা ও দণ্ডাদেশ বাতিল করে যে রায় দিয়েছেন, তা ন্যায়সংগত।
তথ্যাদি ও নথি পর্যালোচনা করে রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, অপরাধের কথিত মাস্টারমাইন্ড (মূল হোতা) মুফতি আবদুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি যেসব পরিস্থিতিতে গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে তার স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় প্রদান বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ সৃষ্টি করেছে; যেখানে তাঁর প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার দীর্ঘ চার বছর পর দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। দীর্ঘ সময় পুলিশ হেফাজতে থাকার পর অপর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনজনের জবানবন্দি একজন ম্যাজিস্ট্রেট একই দিন গ্রহণ করেন। অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ার মধ্যে গ্রহণ করেন, যা প্রযোজ্য আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।
রায়ে বলা হয়, অধিকাংশ অভিযুক্ত ব্যক্তি তাদের জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আবেদনের যুক্তিতে অমানবিক নির্যাতনের কথা বলেছেন। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে তাদের বেআইনি হেফাজতে রাখার ভিত্তিতে স্বীকারোক্তি নেওয়ার বিষয়ে বলেছেন। উল্লিখিত পরিস্থিতি মিলিয়ে বিবেচনা করলে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিগুলো স্বতঃস্ফূর্ত প্রকৃতির বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ সৃষ্টি করে। ১৮৯৮ সালের দণ্ডবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী, আবদুল হান্নানকে পরীক্ষা করার আগেই তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর (অন্য মামলায়) হওয়ায় প্রসিকিউশনের মামলাটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। সর্বশেষ বিশ্লেষণে তাই স্বীকারোক্তিগুলো বিশ্বাসযোগ্যতার বিচারে টেকে না।
মামলার পুনঃতদন্তের আদেশ ছিল ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ : হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, ন্যায়বিচারের জন্য এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে তদন্ত হওয়া দরকার, যা এ মামলার ক্ষেত্রে এখনও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এ মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত। আপিল বিভাগ বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ের এই অংশটুকু প্রত্যাহার করা হলো। পর্যবেক্ষণের আলোকে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছিল হাইকোর্টের রায়ে। আপিল বিভাগ বলেছেন, এই অংশটুকু বাতিল করা হলো।
আসামিদের খালাস দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যেভাবে এ মামলায় পুনঃতদন্তের আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’। যে সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এ মামলার বিচার শুরু হয়েছিল, সেই অভিযোগপত্রই ছিল ‘অবৈধ’। হাইকোর্ট বলে, “সামগ্রিক বিবেচনায় আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এ মামলায় যেভাবে আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া হয়েছে, তা অবৈধ এবং আইনের বিচারে তা টেকে না।”
খালাসের রায় কেন বহাল : আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘিরে গতকাল সকাল ১০টা ৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারক এজলাসে ওঠেন। এ বেঞ্চের বাকি সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। প্রধান বিচারপতি বলেন, “এ মামলায় হাই কোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে সব আসামিকে খালাস দিয়ে যে রায় দিয়েছে, তা অবজারভেশন, এক্সপানশন ও মোডিফিকেশনসহ বহাল রাখা হল। “যারা আপিল করতে পারেননি তাদেরও খালাস দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে এই মামলায় যদি কেউ কারাগারে থাকেন, তার অন্য কোনো মামলা না থাকলে এখনই যেন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।”
রায়ের পর অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, “২১ অগাস্টের গ্রেনেড মামলায় সব আসামিকে খালাস দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। সরকার কর্তৃক আনীত সব আপিল এবং পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে হাই কোর্টের দেওয়া যে রায় তা বহাল আছে। “হাইকোর্ট বিভাগ যে অবজারভেশন দিয়েছিলেন, যে এ মামলার তদন্ত ঠিকমতো হয়নি, এটি পুনঃতদন্ত করতে হবে, সে ব্যাপারে আপিল বিভাগ বলেছে, যেটা আমরা শর্ট অর্ডারে বুঝেছি- তা হলো এটা রাষ্ট্রের কাজ, বিচার বিভাগের কাজ নয়। কাজেই এটা এক্সপাঞ্জ করা হয়েছে।” তিনি বলেন, “নন আপিল্যান্ট, অর্থাৎ তারেক রহমানসহ যারা আপিল করতে পারেন নাই, তাদের খালাসে হাইহোর্টের রায়ও বহাল রাখা হয়ছে।”
শিশির মনির বলেন, “আজকের অবজারভেশনগুলো হলো, যে কনফেশনগুলো দেওয়া হয়েছিল ১২টা স্বীকারোক্তি- এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলোকে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেননি। এই স্বীকারোক্তিগুলো আদায় করা হয়েছে নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে। এই স্বীকারোক্তি আদায় করার আগে কেন ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে তাদের পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হয়নি। “নেওয়া হয়েছিল টিএফআই (টাস্কফোর্স ইন্টেলিজেন্স) সেলে বিচারিক আদেশ ছাড়াই। একই দিনে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তিনটি কনফেশন নিয়েছিলেন, প্রতিটি কনফেশন ৩৬ পৃষ্ঠার, আদালত সেটিও বলেছেন যে এটি আইন দ্বারা কখনও সিদ্ধ নয়।” এ আইনজীবী বলেন, “আরও একটি কনফেশনের কথা বলেছেন, মুফতি হান্নানের কনফেশনের ব্যাপারে। তখন মুফতি হান্নান ছিলেন কনডেম সেলে। কনডেম সেল থেকে এনে তার কনফেশন রেকর্ড করা হয়েছিল। যখন ৩৪২ এ সকল আসামির স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়েছিল, তার আগে মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কাজেই মুফতি হান্নানের ৩৪২ করা হয়নি।” বিএনপি নেতা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, তারেক রহমানের নামে এখন আর কোনো মামলা নেই।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। এতে ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলটির শতাধিক নেতাকর্মী। এ ঘটনায় করা মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। রায়ের পর ২০১৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়।
এটি সংশ্লিষ্ট শাখায় ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। কোনো ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। এটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের জেল আপিল, নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স এবং এসব আপিল ও আবেদনের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর হাইকোর্টে গত ৩১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে গত ১ ডিসেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এই রায় দেওয়া হয়। ফলে মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ দণ্ডিত সব আসামি খালাস পান।