অর্থপাচার কমেছে বলব না, প্রতিরোধক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে
বললেন ইফতেখারুজ্জামান
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, অর্থপাচার কমেছে কি না বলবো না। তবে পাচারের প্রতিরোধক কিছু ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অর্থপাচারের একটা অন্যতম মাধ্যম ব্যাংকিং সেক্টরে কিছু সংস্কার হয়েছে। আগের ঢালাওভাবে ঋণ নিয়ে সেটাকে বিভিন্নভাবে জালিয়াতি করে পাচার করার যে সুযোগটা ছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের যেই অ্যাক্টররা সেখানে জড়িত ছিল, তারা অনেকেই বিভিন্নভাবে হয় দেশের বাইরে অথবা বিচারের মুখোমুখি আছে। তাদের সেই ভূমিকাটাও এখন নেই বললেই চলে। যদিও নতুন অ্যাক্টরের জন্ম হয়নি সেটা আমরা বলতে পারবো না। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে, সংস্কার হয়েছে। যার মাধ্যমে যে পদ্ধতিতে অর্থ পাচার হতো, মোটা দাগে বিশাল অংশটা সেটা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রাখতে পেরেছে।
অভিবাসীকর্মীদের নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিদেশের কর্মরত অভিবাসীকর্মীদের মাধ্যমে একটা বিশাল অংকের অর্থপাচার হয়। তাদের আয়টা বিদেশ থেকে দেশে সরাসরি ব্যাংকিং চ্যানেলে আসার কথা, সেটাকে অপব্যবহার করে সেটা ব্যাংকিং চ্যানেল বাইপাস করে অন্যভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা বিদেশে পাচার হতো। সেটি কিন্তু এখনও মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তবে পুরোপরি নিয়ন্ত্রিত সেটা বলতে পারবো না।
আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্যে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থপাচার হয় জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের সিংহভাগ অর্থপাচারের পুরোটা নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে, সেটা আমি বলতে পারবো না। কারণ সেখানে বাস্তব সংস্কার এখন পর্যন্ত হয়নি। কিছু কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আমাদের সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ছিল। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে আস্তে আস্তে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিরোধ করা আমাদের প্রায়োরিটি হওয়া উচিত, আমাদের প্রাধান্য উচিত। যেন পাচার না হয়। যেটা একবার পাচার হয়ে যায় সেই টাকাটা ফেরত আনাটা খুবই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। ফ্রিজ হওয়া মানে কিন্তু আমরা টাকাটা পেয়ে যাবো, সেটা কিন্তু না। টাকাটা যে বাংলাদেশ থেকে গেছে ওখানকার আদালতে সেটাকে প্রমাণ করতে হবে। এই পুরো প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে ফেরত আনা খুবই কঠিন এবং জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি কাজ। খুব সহজে পাওয়া সম্ভব হবে না।
আইন নিয়ে তিনি বলেন, দেশ থেকে যারা অর্থপাচার করে তাদের পাচারকৃত অর্থ যদি বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকতো তাহলে তারা লন্ডন, কানাডা বা দুবাইয়ে টাকা লগ্নি করতে পারতো না। বাইরে যাওয়ার সুযোগটাকে আমাদের বন্ধ করতে হবে। সেই বন্ধ করার হাতিয়ার আমাদের কাছে কিছুটা আছে, সেগুলোকে আরো শানিত করতে হবে। যে আইনগুলো আছে সেগুলোকে আরো জোড়ালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে আমাদের এটাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। অনুষ্টানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) চেয়ার ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়ান বলেছেন, গণমাধ্যমকে দমন, অবাধ তথ্য প্রবাহ বন্ধ করা এবং সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে হুমকি প্রদর্শন গোপনীয়তার সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয়। আর গোপনীয়তার সংস্কৃতি ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি শক্তিশালী অস্ত্র।
তিনি বলেন, সাংবাদিকরা সত্য তথ্য তুলে ধরেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, সেজন্য তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। সুশীল সমাজের কাছে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনও মাধ্যম নেই, তবে আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিয়ে কথা বলা। আমরা আরও যেটা করি সেটি হলো, এসব ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকি। সহিংস পরিবেশে কখনোই গণতন্ত্র পুনঃস্থাপন করা যায় না।
ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়ান বলেন, ‘সহিংস পরিবেশ ক্ষমতার অপব্যবহার পুনর্বহালে সহায়তা করে। তাই এটি প্রায় সব দেশেই গুরুতর উদ্বেগের যেখানে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষ এই ধরনের সহিংসতার সম্মুখীন হয়।’
দুর্নীতির সুচক নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর দুর্নীতির সুচক প্রকাশ করি যদিও সব সেক্টরের বিষয় সেখানে পুরোপুরি আসে না। এটা সত্য যে বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতির সূচক বাংলাদেশে কমেছে। তবে প্রতিফলন স্বরূপ গতবছর আগস্টে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটতে দেখা গেছে। তারপরে কি দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে, স্পষ্টতই না। তবে কি বেড়েছে? এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশে সংস্কার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। কিছু কাজ শুরু হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নের পথে আছে। এই কাজগুলো কিন্তু দুর্নীতির সূচক উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে। যেসব দেশ তাদের সূচকে উন্নতি করে, আমরা তাদের বলি যেসব ক্ষমতাবান লোক দুর্নীতিতে জড়িত ছিল তাদের বিচারের আওতায় এনে সুশাসন নিশ্চিত করতে।’
ক্ষমতার বিপক্ষে কাজ করা নিয়ে ফ্রাঁসোয়া বলেন, ‘আমরা সবসময় ক্ষমতার সঙ্গে এবং ক্ষমতার বিপক্ষে কাজ করেছি। এর অর্থ হচ্ছে আমরা অংশগ্রহণ করছি আবার সমালোচনাও করছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে কী হয়েছে, আমাদেরও সমালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কোনও সরকার নেই যারা আমাদের সমালোচনা করেনি। আমি মনে করি আগামি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠন হবে সেই সরকারও টিআইবি’র কর্মকাণ্ডে অখুশি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে জিডিপি’র সঙ্গে তুলনা করলে দেখবেন জনগণের টাকা চুরি হয়েছে, জনগণকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে। ঘুষের পেছনে জনগণের যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটার হিসাব কখনও পাচার করা অর্থের সঙ্গে যথাযথভাবে তুলনা করা যাবে না। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যে ১৬ বিলিয়ন ডলার গায়েব হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশের মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে। এই অর্থপাচার না করলে অনেক সুযোগ তৈরি করা যেতো বাংলাদেশে। এই অর্থ বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, অবকাঠামো, জরুরি প্রয়োজনীয় সেবার জন্য ব্যয় করা যেতো। এই অর্থ চুরি না হলে বাংলাদেশের জিডিপি আরও অনেক বেশি হতো।’ ফ্রাঁসোয়া বলেন, ‘আমাদের মতো বৈশ্বিক সুশীল সমাজ বাংলাদেশে বর্তমানে যা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশংসা করছে। তারা বাংলাদেশের দিকে নজর রাখছে। আমরা দেখছি যে বাংলাদেশ সরকার সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছে। এই লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন, ঐকমত্য কমিশন করা হয়েছে। সংস্কার সুপারিশের অনেক কিছুই টিআইবি জানিয়েছে। আমাদের স্পষ্ট পরামর্শ হচ্ছে- এই সংস্কারগুলো টেকসই হতে হবে।’
