জাপা নিষিদ্ধের দাবি জোরালো কার্যালয়ে ফের ভাঙচুর-আগুন
* জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা রাশেদের * সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আমাদের এক থাকতে হবে : জামায়াত * নুরের ওপর হামলার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে : ইসলামী আন্দোলন * ভারতীয় আগ্রাসনকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে : জাগপা * নুরের শারীরিক অবস্থার অবনতি * নুরের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিদেক

রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ফের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় এ ঘটনা ঘটায় বিক্ষুব্ধরা। এতে জাতীয় পার্টির পাঁচতলা ভবনের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে। এর আগে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবিতে শাহবাগে গণঅধিকার পরিষদ সমাবেশ করে। দলটির সংহতি সমাবেশে বিএনপি ও জামায়াতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশগ্রহণ করেন। সমাবেশ শেষে শাহবাগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শাহবাগ মোড়ে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। পরে মিছিল নিয়ে বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে পৌঁছেন নেতাকর্মীরা।
রমনা থানার ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ কয়েকজন দুর্বৃত্ত জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা চালায়। তারা ভেতরের কিছু আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায় ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।’
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ডিউটি অফিসার রোজিনা আক্তার বলেন, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুনের সংবাদ পেয়ে আমাদের ইউনিট সেখানে পাঠানো হয়।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল করিম ভূঁইয়া অভিযোগ করেন, গণঅধিকার পরিষদ ব্যানার সহকারে মিছিল নিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে। তারা জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগান দিতে দিতে আগুন দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যায় পৌনে ৬টার দিকে কিছু মানুষ জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে আসেন। পরে তারা অফিস টার্গেট করে কয়েক দফা হামলা চালান এবং পরে অগ্নিসংযোগ করেন। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক দোকানি বলেন, ‘হঠাৎ কয়েকজন যুবক স্লোগান দিতে দিতে এসে অফিসে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করেন। এরপর ধোঁয়া উঠতে দেখি। পুলিশ আসার পর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।’ সেখানে অবস্থানরত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব জুবায়ের আলম রবিন সাংবাদিকদের জানান, একটি দলের নেতাকর্মীরা শাহবাগে সমাবেশ থেকে মিছিল নিয়ে এসে আমাদের কার্যালয়ে হামলা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বারবার এমন বর্বর আচরণ করা হচ্ছে। তিনি তাদের বিচার দাবি করেন। অপরদিকে গণঅধিকার পরিষদের দফতর সম্পাদক শাকিল উজ্জামান বলেন, ‘জাতীয় পার্টি একটি দেশবিরোধী দল। বিক্ষুব্ধ জনতাই তাদের কার্যালয়ে ভাঙচুর করেছে।’
গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে গণঅধিকার পরিষদের সংহতি সমাবেশে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন দিয়ে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। হাসিনার মতো তাদেরও দেশ থেকে হটাতে হবে। ব্যর্থতার দায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় সচিবালয় ঘেরাও করে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নামানো হবে।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় জড়িতদের শাস্তি, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং ব্যর্থতার দায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তিন দফা দাবিতে আয়োজিত এই সংহতি সমাবেশে যোগ দেন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা।
রাশেদ অভিযোগ করে বলেন, ‘নুরের ওপর হামলাকারী পুলিশ ও সেনা সদস্যদের বিচার করতে হবে। কারণ তারা আওয়ামী দোসর। তাদের গ্রেপ্তার না করলে সেনাপ্রধানও দায় এড়াতে পারবেন না। ভিডিও ফুটেজ থাকলেও একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারেননি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।’ তিনি বলেন, ‘ভারত জাতীয় পার্টিকে প্রধানবিরোধী দল বানানোর ষড়যন্ত্র করছে। আমরা আগামীতে বাংলাদেশের বিষয়ে দেশটিকে নাক গলানোর সুযোগ দেব না।’ অন্যান্য দলের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব, সদস্য সচিব আতাউল্লাহ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন্দ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ একাংশের মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম, বাংলাদেশ নেজামে ইসলামী পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইজহার, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপার মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) মহাসচিব মোমিনুল আমিন, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা বাচ্চু ভূঁইয়া, জনতার অধিকার পার্টির আহ্বায়ক তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মজুমদার, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যান ফিরোজ মো. লিটন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন শামীম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী। গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন, বাংলাদেশ শ্রমিক অধিকার পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান প্রমুখ।
অন্যান্য দলের নেতাদের বক্তব্য : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, ‘নুরের ওপর হামলা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জুলাইয়ের বিরুদ্ধে হামলা। এতে আর্মি ও পুলিশের কতিপয় সদস্য জড়িত। আমাদের দুর্ভাগ্য প্রশাসন থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদেরকে এখনও তারাতে পারিনি। আগামীতে এ ধরনের হামলা হলে প্রতিরোধ করবো। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আমাদের এক থাকতে হবে।’ বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘সেনা ও নৌবাহিনী এবং পুলিশকে সংস্কার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘কতিপয় সুশীল আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেন। আমরা তাদেরকে রাজপথে মোকাবিলা করব।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, ‘নুরের ওপর হামলার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। হাসিনার দোসররা সেনাবাহিনীসহ সব জায়গায় রয়েছে।’ তিনি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে স্বাক্ষর করতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানান।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দল ও ভারতীয় আগ্রাসনকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে।’ সমাবেশ শেষে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হাতে হাত রেখে শপথবদ্ধ হন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ ৩০টি দলের প্রতিনিধিরা।
নুরের শারীরিক অবস্থার অবনতি : গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তাকে আপাতত সম্পূর্ণ নিরিবিলি পরিবেশে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। গতকাল শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নুরের পেজ থেকে এক এডমিন পোস্টে এসব তথ্য জানায়। এতে দলীয় নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাসপাতালে ভিড় না করতে অনুরোধ জানানো হয়।
তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন : গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের ওপর হামলা এবং গুরুতর আঘাতের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করেছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সরকার দ্য কমিশনস অব ইনকোয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা এবং গুরুতর আঘাতের ঘটনা তদন্তের জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করল।’ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আলী রেজাকে সভাপতি করে কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকে সদস্য করা হয়েছে।
